বস্তিতে আগুন আর আবাসনের স্বপ্ন
ঢাকা থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলম ও ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
প্রতিবছর ঢাকা শহরের অসংখ্য বস্তিতে অগ্নিকান্ড ঘটে। হাজার হাজার নিম্ন আয়ের মানুষ এই দাবানলে সর্বশান্ত হয়ে পড়ে, কখনও কখনও নির্মমভাবে প্রাণ হারায় অনেক মানুষ। বস্তির মানুষগুলো আসে দেশের নানান প্রান্ত থেকে। প্রায় সকলেই এক বস্ত্রে চলে আসেন ঢাকায়। কেউ এসে ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নেন আর তার পরেই পরিবারকে নিয়ে আসেন। তাদের সেই ছ্ট্টো ঘরের প্রতিটি সম্বলই তাদের কাছে খুব মূল্যবান। অবশ্য তাদের সম্বল বলতে বস্তির একটা ঘর, ঘরের মধ্যে থাকা হাড়ি-পাতিল, একটা ট্রাংক, কাপড়, লেপ, কাথা বালিশ বা তাদের সন্তানদের একটা দুটো বই, খেলনা, কিছু জমানো টাকা। কথাগুলো শুনতে হয়তো খারাপ শুনালো কিন্তু এই সামান্য সম্বল তৈরি করতেও তাদের অনেক দিনরাত একাকার করে কাজ করতে হয়। বস্তির ঘরগুলো খুব অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর আর বসবাসের অনুপযোগী। কিন্তু এই ঢাকা শহরের বস্তিগুলোতে বসবাস করে লাখ লাখ মানুষ খুব মানবেতরভাবে। ২০০৫ সালের আরবান স্টাডিস এর হিসাব মতে মোট বস্তিবাসীর সংখ্যা ছিল ৩৪,২০,৫২১ জন যা ঢাকার মোট জনসংখ্যার ৩৭.৪%। জনবহুল ঢাকা শহরে চল্লিশ লক্ষের অধিক বস্তিবাসী মানুষ করে।
নগর এবং গ্রামের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানাবিধ প্রাকৃতিক আপদ যেমন; বন্যা, নদীভাঙ্গন, জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, শৈতপ্রবাহ, লবণাক্ততার কারণে মানুষ জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে ভিড় করছেন। ফলে সহজলভ্যতার কারণে তাদের অধিকাংশেরই জায়গা হচ্ছে শহরের অপরিকল্পিত এবং অপরিচ্ছন্ন বস্তিতে ও ফুটপাতের খোলা জায়গায়। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব গ্রামের পাশাপাশি শহরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগের এই প্রভাব শহরের বস্তিবাসীর জীবনকে আরও অসহনীয় করে তুলছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন আঞ্চলের বস্তিগুলোতে প্রায়ই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। সহায় সম্বলের পাশাপাশি এই সব অগ্নিকান্ড কেড়ে নেয় প্রাণও। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যানুযায়ী, গত বছর ২০১৮ সালে সারাদেশে ১৬৫টি অগ্নিকান্ড ঘটে, যার মধ্যে ঢাকাতে ঘটে ৩৩টি অগ্নিকান্ড। গড়ে প্রতি ৩ দিন অন্তর দেশের কোথাও না কোথাও বস্তিতে অগ্নিকান্ড ঘটে। এই সব অগ্নিকান্ডে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯৪ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত সারা দেশে ২৮টি বস্তিতে অগ্নিকান্ড ঘটেছে এবং সম্পদ হানির পাশাপাশি এই ঘটনায় ১৮ জন নারী-শিশু-বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনের ঝিলপাড়ের চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ অগিকান্ডে আনুমানিক ৫ হাজার পরিবারের স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রতিটি পরিবারের গড়ে ৩০ হাজার টাকার সম্পদ নষ্ট হলে গড়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ কোটি টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে খাওয়া ও থাকার আপাত ব্যবস্থা করলেও সব হারিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
যখন বস্তি পুড়ছে না, তখনো বস্তির জীবন এক যুদ্ধ। আর যখন পুড়ছে তখন তাদের আর করার কিছু থাকে না। বাংলাদেশের প্রাণশক্তি ফিরে পেতে তাই গুলশান বনানীতে গিয়ে লাভ নেই, যেতে হবে বস্তিতে বস্তিতে। বড় বস্তি মানে বারবার আগুনে পোড়ার ইতিহাস এবং বারবার আগুনকে পরাজিত করে আবার জীবনের খুঁটি মাটিতে পোঁতার ইতিহাস।
বস্তিতে বারবার অগ্নিকান্ডের কারণ কি? বস্তির অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, সরকারি জায়গা দখল নিতে সুবিধাভোগীদের দুর্বূত্তরা বস্তিতে আগুন লাগায়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সেই সরকারের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মীর প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসীরা অগ্নিকান্ড সংঘটন করে। প্রতিটি ঘটনার পরই গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু তদন্তের পরও বস্তিবাসীদের অভিযোগের সত্যতা পায় না সংশ্লিষ্টরা। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে বস্তিতে বারবার কেন আগুন লাগে? বস্তির আগুন কি দূর্ঘটনা নাকি নাশকতা? কেনইবা বস্তির আগুন সবসময় সরকারি বন্ধ বা ছুটির দিনে ঘটে?
গত ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে আওয়ামীলীগের সভাপ্রধান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কামরাঙ্গীচরে এক নির্বাচনী জনসভায় ঘোষণা করেন; ”কেবল বড়লোকেরাই ফ্ল্যাটে থাকবে এবং বহুতল ভবনে থাকার সুয়োগ পাবে, তা হবে না। মধ্য ও নি¤œ আয়ের মানুষেরা যাতে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে ফ্ল্যাটে থাকতে পারে আমরা এই সুবিধা করে দিচ্ছি। আমরা এই এলাকার নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য ১০ হাজার ফ্ল্যাট তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। অনুরূপভাবে ১৯ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক ভাষণে বলেছেন, “বস্তিবাসীরা ২০ তলা ফ্ল্যাটে থাকবে। ঢাকা শহরে বিত্তবানরাও যেমন থাকবে; তেমনি বস্তিবাসীরাও থাকবে। কারণ তারাও তো মানুষ।”
বারসিক’র একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ঢাকা শহরের অধিকাংশ বস্তি ব্যক্তিমালিকাধীন, বাকিগুলো সরকারি জায়গায় গড়ে উঠেছে এবং বেশ কিছু মানুষ ভাসমান অবস্থায় থেকে জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সব বস্তিগুলোর অধিকাংশ নগরের নদী, খাল, ও জলাভূমির কাছে এবং শহরের প্রান্তিক এলাকায় অবস্থিত। এইসব বস্তির পরিবেশ অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন, অমানবিক ও ঘিঞ্জি। এখানে পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অপ্রতুল, নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোন সঠিক পরিকল্পনা। গবেষণায় দেখা গেছে বস্তিতে প্রতিটি ল্যাট্রিন / টয়লেটে গড়ে ১৫০-২০০ জন মানুষ ব্যবহার করে যা কোনভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এছাড়া তারা একটি বাতির জন্য দেন ২৫০ টাকা। দুইটি বাতি একটি ফ্যান ব্যবহার করলে মাসিক ভাড়া দেন ৭৫০ টাকা। মৌলিক অধিকারের মুখে ছাই মেখে সরকারি পানি বিদ্যুৎ, গ্যাস কিনতে হয় বাজার মূল্যের চাইতে অনেক বেশি দামে। প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া তাদের অল্প আয়, নিম্নমানের তৈলযুক্ত খাবার গ্রহণ, অসচেতনতা, চিকিৎসার অভাব এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার কারণে দ্রুতই তাদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়। ফলে তারা ডায়রিয়া, কলেরা, জ¦র, কাঁশি, গ্যাস্ট্রিক, হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের আয়ের অধিকাংশ টাকা খরচ করে ফেলে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বস্তিবাসীরা যে আয়তনের জন্য ২৫০০-৩০০০ টাকা মাসিক ভাড়া দেয়, আয়তন ও অন্যান্য সুবিধা বিবেচনায় তা বনানী-গুলশানের এপার্টমেন্টের ভাড়ার চেয়েও বেশি ভাড়া। ঢাকার প্রায় সবকটি বস্তিতেই স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, পয়োঃনিষ্কাশন এবং বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা নেই বরং আছে বিচারহীনতা এবং শোষণ। অন্যদিকে উচ্ছেদ সমস্যা বস্তিবাসী মানুষের আরেকটি আতংকের নাম। সম্প্রতি ঢাকার ভাষানটেকে থেকে প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে তাদের অমানবিকভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা অমানবিক কাজ। বস্তি নিয়ে বারসিক’র গবেষণায় ২৩ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন উচ্ছেদের কারণে তারা বস্তি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। এই শহরের বস্তিবাসীরা হাজারো পেশায় যুক্ত থেকে শহরটাকে সচল করে রেখেছেন কিন্তু রাষ্ট্র এই দরিদ্র জনগোষ্ঠির জীবনকে সচল রাখার জন্য উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপই নেয়নি।
বস্তিবাসীরা মানুষ আর বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সকল মানুষের দায় দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই যেকোন ধরনের উচ্ছেদ আর অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বস্তিবাসীরা যে মানবেতর জীবনযাপন করেন তা আমাদের রাষ্ট্রের দৈন্যতার প্রকাশ ঘটায়। কিন্তু আমরা খুবই আশাবাদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার একাধিক বক্তব্যে বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসনের ঘোষণা দিয়েছেন। তার ঘোষণার পথ ধরেই বস্তিবাসীরা ঠাঁই পাবে, আশ্রয় পাবে, পাবে বাঁচার অধিকার। নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন অধিকারের শ্লোগান আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড আরবান ফোরামের মূল কথাই হলোই” সবার জন্য নগর, সবাইকে নিয়েই নগর।”
তৃতীয় ছবিটি সংগৃহীত