ভালো নেই সিলেটের খাসি আদিবাসীরা

এক
ভালো নেই সিলেটের সাধারণ খাসি আদিবাসীরা! জীবন, জীবিকা, অস্তিত্ব নিয়ে তাঁরা যারপনাই চিন্তিত, আশংকিত। সাম্প্রতিক সময়ে খাসি আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকায় নানান ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে! তাদের বসতভিটা, পান বাগান, গাছ, পানপাতা হামলার শিকার হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ‘বাজারমূল্য’ রেকর্ড পরিমাণে কমে যাওয়া। তাদের ভালো থাকার সব ধরনের আনুষঙ্গই আজ নাজুক অবস্থানে আছে। জমি, ঐহিত্যবাহী জীবিকা হারানো এবং শারীরিক ও মানসিক সহিংসতা সন্মূখীন হওয়ার আশংকা খাসিদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আতংকে এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে তারা দিনযাপন করছেন। অনাগত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলেই তাদের চোখমুখে অজানা একটা ভয় ও আশংকা ভর করে! কী হবে? কী করবেন? এবং কোথায় যাবেন?-তা নিয়ে ভাবতেই তাদের মন প্রতিদিনই ভেঙে পড়ছে! অবশ্য জমি ও বসতভিটা রক্ষার জন্য খাসি নেতা বা নেত্রীগণ প্রশাসন, আদালত দারস্থ হচ্ছেন! সাধারণ মানুষেরা নেতানেত্রীদের পাশে থাকার জন্য, তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কৃষিপণ্যের বাজারমূল্য কম বলে ধারদেনা করে তারা সাহায্য করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু যাদের সাথে সাধারণ খাসিদের লড়াই চলছে তাদের বিরুদ্ধে কী বিজয় হবে খাসিদের? তারা কী টিকিয়ে রাখতে পারবেন তাদের জীবন, অস্তিত্ব এবং ঐতিহ্যবাহী জীবিকা? সাধারণ খাসিরা যে এখন লড়ছেন দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান, বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ নানান অপশক্তির সাথে! ক্ষমতাহীনতায় বারবার নিজের সাথে যুদ্ধ করছেন, অনেককিছু করার অভিপ্রায় থাকলেও নানান পারিপার্শ্বিকতার কারণে তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না! তাই করতে না পারার ‘অপরাধবোধ’ তাদেরকে তিলে তিলে মেরে ফেলছে! এছাড়া প্রতিনিয়ত হুমকি ধামকিও পাচ্ছেন। হুমকি ও নাশকতার ভয়ে কারও কারও মুখের ভাষাও এখন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম; কেউ কেউ এখন ‘বোবা’ও হয়ে যাচ্ছেন! নানান শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং অন্যায় দেখার পরও ‘প্রতিবাদ’ করার সাহস না পাওয়ায় কেউ কেউ তো প্রতিদিনই ‘মৃত্যুবরণ’ও করেছেন! তাদের হৃদস্পন্দন চলমান থাকলেও শারীরিক ও মানসিকভাবে যেন মৃতপ্রায় এক সত্তা! এমন আতংক, মানসিক যন্ত্রণা ও অনিশ্চয়তায় খাসিরা কস্মিনকালেও ছিলেন না!

দুই
করোনা মহামারির পর থেকেই খাসিদের কৃষিজ পণ্য বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী ও তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘পান’ এর মূল্য রেকর্ড পরিমাণে কমে গেছে। পানবাগান থেকেও আসা পানের পরিমাণ দিনকে দিন কমেই যাচ্ছে। এ বছরের প্রয়োজনের তুলনায় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানের উৎপাদন অনেকটা কমে গেছে বলে খাসি আদিবাসীরা জানিয়েছেন। বৃষ্টিপাত হওয়ার তারতম্য, প্রচণ্ড তাপদাহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলে বিজ্ঞানীরা অনেকবারই বলেছেন। সাধারণ খাসি আদিবাসীরা ‘জলবায়ুর’ এ খেলা সম্পর্কে এতটা অবগত না হলেও তারা প্রকৃতিনির্ভর চাষবাসে বেশি অভ্যস্ত। জলবায়ুর এই দ্রুত পরিবর্তনে তাদের কোন ভূমিকা নেই; বস্তুত বাংলাদেশের মানুষেরই কোন ভূমিকা নেই। তবে জলবায়ুর এ বৈরী প্রভাবের ভুক্তভোগী শিকারের তালিকায় খাসিরা সবার ওপরে বংশপরম্পরায় প্রকৃতিনির্ভর চাষবাসের কারণে। অন্যদিকে জলবায়ুর এ বৈরী আচরণের সাথে যুক্ত হয়েছে কোভিড-১৯। এই কোভিড-১৯ কারণে পানের বেচাকেনাও কমেছে। দূরবর্তী এলাকার পান ক্রেতারা আগের তুলনায় খাসি গ্রামে কম আসেন; বিশেষ করে দেশে নানান নামের ‘লকডাউন’ চলার সময়ে তো স্থানীয় বিক্রেতারাও আসতে পারেননি পান কিনতে! ফলশ্রুতিতে পচনশীল পানের বাজারজাতকরণে খাসি আদিবাসীরা নানান সমস্যায় জর্জরিত হয়েছেন। এ বছর পানের উৎপাদন কম হওয়ায় অনেক খাসিই মনে করেছেন অন্তত বাজারমূল্য ভালো পাবেন। কারণ অর্থনীতির সাধারণ একটি সূত্রমতে, যোগান বেশি হলে পণ্যের মূল্য কম হয় এবং যোগান কম হলে চাহিদা বেশি থাকায় পণ্যের মূল্য বেশি হবে। তবে দুঃখের সাথেই বলতে হয় খাসিদের কৃষিজপণ্য বাজারজাতকরণে অর্থনীতির এই সূত্র খাটেনি! পানের যোগান ‘গাণিতিক’ হারে কমলে বাজারমূল্য যেন জ্যামিতিক হারে কমছে! তাই জীবিকা পরিচালনায় তারা হিমশিম খাচ্ছেন। প্রকৃতির বৈরীতা, করোনার প্রভাব এবং জলবায়ুজনিত নানান প্রভাবে কারণে তাই সাধারণ খাসিরা দিনকে দিন আরও প্রান্তিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছেন। কৃষিজপণ্যের বাজারমূল্য কম হওয়ায় অতীতে যে পরিমাণ পান উৎপাদন করে সংসারের খরচ মিটানো যেত আজ সে একই পরিমাণ আয় দিয়ে কোনভাবেই তারা সংসারের চাকাকে সচল করতে পারছেন না!

তিন
পান বিক্রি করে সংসার পরিচালনার জন্য খাসিদের সবকিছুই বাইরে থেকে কিনতে হয়। এছাড়া রয়েছে সন্তান-সন্ততিদের লেখাপড়ার খরচ। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ থাকলেও বন্ধ হয়নি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন দেওয়াসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচ। প্রতিমাসেই তাদেরকে বহন করতে হয় সন্তানদের শিক্ষার খরচ যদিও সন্তানদের শিক্ষায় কোন অগ্রগতি নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান না হওয়ার কারণে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের সন্তানেরা শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়েছে, মোবাইল গেম্স-আসক্ত হয়েছে অনেকে। বর্তমানে অনেক খাসি কিশোর-যুবক মোবাইল গেমসে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। খাওয়াদাওয়া-নাওয়া ভুলে দিনরাত ওই গেমস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এতে খাসি অভিভাবকদের কপালের চিন্তার ভাজ আরও প্রসারিত হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবারও খোলা হল এবং আংশিকভাবে পাঠদানও হলো কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা থেকে বিচ্যুত থাকার কারণে তাদের সন্তানেরা শিক্ষায় অতীতের তুলনায় কম মনোযোগী হচ্ছে, যা অভিভাবকদের পীড়া দিচ্ছে বেশি! জীবিকা, অস্তিত্ব এবং সন্তানদের একটি সম্ভাবনাময় জীবন দেওয়ার চিন্তায় সারাক্ষণই মগ্ন থাকতে হয় সাধারণ খাসিদের! কিন্তু কোনদিক থেকেই আশার আলো পাচ্ছেন না তারা। তাদের জীবিকা আজ অনেকটা অনিশ্চিত, জীবন-অস্তিত্ব ঝুঁকিযুক্ত এবং সুন্দর ভবিষ্যত রচনার ‘ভিত্তি’ দুর্বলতর হচ্ছে দিনকে দিন।

চার
জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা, কৃষিজপণ্যের ক্রমহ্রাসমান বাজারমূল্য, জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাব, করোনার হানা এবং সুন্দর ও স্বচ্ছল জীবনপরিকল্পনার ভিত্তি দুর্বল হওয়ার কারণে সাধারণ খাসিরা আজ সত্যিকার অর্থে চোখে অন্ধকার দেখছেন। সাধারণত নভেম্বর মাস থেকে খাসিদের নানান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসব শুরু হয়। কিন্তু জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, কৃষিজপণ্যের রেকর্ড মূলহ্রাস, উচ্ছেদ আতংক এবং সহিংসতা শিকার হওয়ার ঝুঁকির আশঙ্কায় এসব উৎসব পালনে খাসিদের ভেতরে খুব একটা উৎসাহ দেখা যায়নি এ বছর। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের ২৫ এবং পহেলা জানুয়ারি মাসে নতুন বছর পালন হয় প্রতিটি খাসি গ্রামেই। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতিটি খাসি গ্রামেই নানান সভা ও পরিকল্পনা শুরু হয়। কিন্তু অনেকের সাথে কথা বলে জেনেছি, এ নিয়ে খাসিদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই এবার। এই উদ্বিগ্নতা, অনিশ্চিত জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত যন্ত্রণা থেকে সাধারণ খাসিরা মুক্তি পেতে চান। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। তাঁরা ভূমি অধিকার, বন ও জঙ্গলের ওপর প্রথাগত অধিকারের স্বীকৃতি চান। এছাড়া পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ভর্তুকির নিশ্চয়তা দাবি করেন। ভূমি এবং বনের ওপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ ভর্তুকির নিশ্চয়তা পেলে খাসি আদিবাসীদের উল্লেখিত সমস্যাগুলো অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে। অন্যদিকে দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁদের মৌলিক অধিকার তথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে খাসিরা পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চার মাধ্যমে দেশের বনাঞ্চল রক্ষা ও সংরক্ষণে আরও দৃঢ় পদক্ষেপে চালিয়ে যেতে পারবেন। এতে করে দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতি এই উভয় খাতের জন্য মঙ্গল ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে বলে তারা মনে করেন।

ফিচার ছবি: সাজু মারছিয়াং

happy wheels 2

Comments