স্বাস্থ্যক্যাম্প বস্তিবাসীদের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে
ঢাকা থেকে সুদিপ্তা কর্মকার এবং জাহাঙ্গীর আলম
চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকারের অংশ। এটা মানবাধিকারের অংশও বটে। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে চিকিৎসা সেবা বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্ত দেশের বিপুর জনগোষ্ঠি, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, জনসচেতনতার অভাব, সেবা প্রদানকারীদের অনীহা, ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার অভাবের কারণে দেশের দরিদ্র সমাজ রাষ্ট্র কর্তৃক বরাদ্দকৃত স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। গ্রাম থেকে নগরের নি¤œ আয়ের মানুষেরা স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হতে হতে তারা তাদের অধিকারের জায়গাটাও ভুলে যান। তারা যে এই দেশ ও নগরের মানুষ এবং সরকারি ও বেসরকারী সেবাতে তাদের যে অধিকার আছে তা তারা মনে করতেই ভয় পায়। ফলে তারা সেবা গ্রহণের পরিবর্তে স্থানীয় ফার্মেসী থেকে দেওয়া ওষুধ কিনে রোগ মুক্তির চেষ্টা করেন। ফার্মেসী থেকে কিনে নেওয়া ওষুধ অধিকাংশ সময় তাদের স্বাস্থ্যের উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি করে। এর ফলে তারা দীর্ঘদিন যেমন রোগে ভূগেন, তেমনিভাবে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায় ভুল ওষুধ ব্যবহারের কারণে। যা তাদের স্বাস্থ্য ও প্রতিদিনের জীবিকার উপর বিরাট প্রভাব ফেলে। তারা বাধ্য হয়ে সংসার পরিচালনার জন্য ঋণ গ্রহণ করে। এভাবেই তাদের ঋণের জালে আটকা পড়ে যায়। নগরের এই নি¤œ আয়ের বস্তিবাসীরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের প্রভাব গ্রামের সকল সম্পদ ফেলে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন এবং তাদের বসবাসের জায়গা হচ্ছে নগরের প্রান্তিক এলাকায় গড়ে ওঠা বস্তি, ঝুঁপরি বা ফুটপাতের খোলা জায়গায় যেখানে বেঁচে থ্কাার সাধারণ চাহিদা অনুপস্থিত। জলবায়ু পরিবর্তনের এই অভিঘাত নগরের নি¤œ আয়ের বস্তিবাসীর মানুষদের জীবনকে অসহনীয় করে তুলছে।
ঢাকা শহরের অধিকাংশ বস্তিগুলো নগরের প্রান্তিক ও নীচু এলাকায় সরকারি ও বেসরকারী জমিতে গড়ে উঠেছে। ফলে শহরের অধিকাংশ বর্জ্য, বৃষ্টি ও নগরের মানুষদের নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত দুষিত পানি বিভিন্ন নালা, খাল এবং ড্রেনের মাধ্যমে এইসব এলাকার ভেতর দিয়ে নিষ্কাশিত হয়। ফলে এই বস্তিবাসী মানুষদের জীবনে পারিপাশ্বিক পরিবেশ ও দুর্গন্ধ তাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী হিসেবে মিশে রয়েছে। পাশাপাশি বর্ষকালে অধিকাংশ বস্তিবাসী এলাকায় বন্যা ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এবং বস্তিবাসী মানুষদের বসবাসের ঘরের মধ্যে ময়লা যুক্ত পানি উঠে যায়। একই সাথে ডুবে যায় তাদের টয়লেট, বাথরুম, রান্নাঘর, পানির কল, রাস্তাঘাট। ময়লা এবং দূর্গন্ধযুক্ত পানির মধ্যেই তাদের চলাফেরা ও পারিবারিক অন্যান্য কাজ করতে হয়। ফলে এক অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। বস্তির অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব, জলবদ্ধতা, ময়লা পানি ও আবর্জনা থাকার কারণে মশার প্রাদূর্ভাব অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। বর্ষাকালে মশার কামড়ে বস্তিবাসীদের অনেকেই ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে সংকটে পড়ে যায়। এর ফলে দীর্ঘদিন তারা কাজ করা থেকে বিরত থাকে যার প্রভাব পড়ে তাদের প্রত্যহিক জীবনব্যবস্থার উপর। এছাড়াও বর্ষকালে প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে তাদের নানান ধরণের সমস্যা হয়। শীতের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মধ্যে পড়ে শিশু এবং প্রবীণ ব্যক্তিরা। শিশুদের সর্দি, কাঁশি এবং প্রবীণদের শারীরিক নানান ধরণের সমস্যা তৈরি হয়। আর শৈত্যপ্রবাহ হলে এই অসুখের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।
ঋতু পরিবর্তন এর সময়, শীতকাল থেকে গ্রীষ্মকাল শুরুর প্রাক্কালে ঠান্ডা, কাশি, জ¦র, ডাইরিয়া, ডিসেন্ট্রি ইত্যাদি রোগ এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে এ বছর এই সময়ে ঢাকা শহরে ডায়রিয়ার প্রকোপ অত্যাধিক হারে দেখা গেছে। পানিবাহিত এই রোগ এখন ঢাকায় বেশিরভাগ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে যার মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকা অন্যতম। বস্তিগুলোতেই এমনিতেই পানির সমস্যা থাকে তার মধ্যে সুপেয় পানির অভাব আরও বেশি থাকে। অধিকাংশ সময়ে বস্তিবাসী নি¤œ আয়ের মানুষেরা দিনে মাত্র দুইবার পানি পায় যা তারা বিভিন্ন ধরণের পাত্রে ধরে রেখে সারাদিন ব্যবহার করেন। এছাড়াও বস্তির দুষিত পরিবেশ এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার কারণেও তারা খুব বেশি অসুস্থ হয়ে থাকে। নগরের নি¤œআয় এর মানুষদের আয় এর একটি বড় অংশ খরচ হয় চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর পেছনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বস্তিগুলোর কাছে কোন সরকারি হাসপাতাল না থাকায় তারা টাকার অভাবে বেসরকারী হাসপালে ডাক্তার দেখাতে পারেন না এবং নিকটস্থ ফার্মেসী থেকে ওষুুধ কিনে খায়, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার এ্যান্টিবায়োটিক এবং অতিরিক্ত ওষুধ দিয়ে থাকে। যার ফলে একদিকে তাদের খরচ বেশি হয় অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভোগা শুরু করে।
বারসিক গবেষণায় দেখা যায়, শীতকালে দূর্যোগের মধ্যে তীব্র শীতের কথা বলেছেন ৩৭ ভাগ উত্তরদাতা, কম শীতের কথা বলেছেন ১৫ ভাগ উত্তরদাতা, ২ ভাগ উত্তরদাতা আগুনের সমস্যার কথা কবলেছেন। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে গ্রীষ্মকালে ঢাকার তাপমাত্রা বাংলাদেশের যে কোন গ্রামীণ এলাকার তাপমাত্রার চেয়ে ২ ডিগ্রি থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি থাকে। গ্রীষ্মকালে তাপ প্রবাহের কারণে অধিকাংশ বস্তিবাসী দিনের অধিকাংশ সময় কাজ করতে পারে না। গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের উপর চাপ বেশি থাকায় তার প্রভাব পড়ে বস্তিবাসীদের জীবনের উপর। দিনের পাশাপাশি রাতেও বিদ্যুৎ না থাকার কারণে গরমে তারা ঘুমাতেও পারে না এবং নির্মূম রাত কাটানোর ফলে পরের দিনও তারা ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। যার প্রভাব পড়ে তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ও মাসিক আয়ের উপর। অধিক গরমের কারণে ডায়রিয়া আমাশয়, হাঁপানিসহ বিভিন্ন ধরণের রোগে আক্রান্ত তারা হয়। ক্রান্তীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ তথা ঢাকার অবস্থানের কারণে এখানে গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড ঝড়, তুফান এবং বৃষ্টির মতো দুর্যোগ হয়ে থাকে। ফলে বস্তি এলাকায় বন্যা, জলাবদ্ধতা এবং ঝড়ে ঘড়বাড়ি ভেঙ্গে যায়। প্রাপ্ত গবেষণায় দেখা যায়, বস্তি এলাকায় গ্রীস্মকালে প্রায় ৪৩ ভাগ উত্তরদাতা তাদের জীবনপ্রবাহে দূর্যোগের মধ্যে গ্রীষ্মকালে হিটওয়েভ বা তাপ প্রবাহের দূর্যোগের কথা বলেছেন। প্রচন্ড ঝড় ও বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট দূর্যোগের কথা বলেছেন ৬ ভাগ উত্তরদাতা। জলবদ্ধতার কথা বলেছেন ৫ জন উত্তরদাতা এবং আগুন লাগার কথা বলেছেন ৮ ভাগ উত্তরদাতা, যার জন্য তারা সর্বদা মানুষিক অস্বস্তি মধ্যে থাকে।
বস্তিবাসীদের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত দূর্বল অবস্থা হওয়ার কারণে বর্ষাকালে তাদের সমস্যার অন্ত থাকে না। বর্ষাকালে অধিকাংশ বস্তিবাসীদের ঘরের মধ্যে বন্যার পানি উঠে যায়। এমনকি অনেক সমস্যা পানি সঠিকভাবে নিষ্কাশনের অভারের কারণে জলবদ্ধতাও তৈরি হয়ে যায়। ময়লা এবং দূর্গন্ধযুক্ত পানির মধ্যেই তাদের চলাফেরা ও পারিবারিক অন্যান্য কাজ করতে হয়। পাশাপাশি ময়লা পানি ও আবর্জনা থাকার কারণে মশার প্রাদূর্ভাব অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। মশার কামড়ে বস্তিবাসীদের বিভিন্ন ধরণের অসুখ বিসুখ হয়ে থাকে। ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় জানা যায়, ২০১৭ সালে বস্তিবাসীদের অধিকাংশ মানুষই চিকুনগুনিয়া রোগে এবং ২০২১ সালে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করেছেল। ফলে তারা দীর্ঘদিন কাজ করতে পারেনি যার প্রভাব পড়েছিল তাদের প্রত্যহিক জীবন ব্যবস্থার উপর। নগরজীবনে জলাবদ্ধতা ও ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া বস্তিবাসীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এই সমস্যা বস্তিবাসী ছাড়া নগরের ধনী শ্রেনীরাও মুখোমুখি হয়ে থাকে। বস্তিবাসীদের ৭৮ ভাগ উত্তরদাতা বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা ও ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ার সমস্যার কথা বলেছেন। মোট ৩ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন বর্ষকালে প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে তাদের নানান ধরণের সমস্যা হয়।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিগত তিন বছরে অনেকগুলো ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প আয়োজন করা হয়েছিল বস্তিবাসীদের চাহিদার ভিত্তিতে এবং প্রতিবছরই তারা এই কর্মসূচিকে অনেক প্রশংসা করেছেন। প্রতি স্বাস্থ্যক্যম্পেই প্রায় ১২০- ১৩০ জন রোগে স্বাস্থ্যসেবা, ঔষধ ও ব্লাড গ্রুপিং এবং ডায়াবেটিক সুবিধা নিয়েছেন। অনুরূপভাবে গত ১১ই এপ্রিল, ২০২২ইং তারিখে বারসিক কর্তৃক মোহাম্মদপুর চাঁদউদ্যান এর সোনামিয়ারটেক বস্তির নি¤œআয়ের মানুষদের জন্য বস্তি সংলগ্ন বেসরকারী সংস্থা কারিতাসের আলোকিত শিশু প্রকল্প সেন্টারে এক ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প এর আয়োজন করা হয়। উক্ত মেডিকেল ক্যাম্প এ গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা: তানিয়া হাফিজ, শিশু বিশেষজ্ঞ ডা: বৃষ্টি এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা: আব্দুল্লাহ আল হাসান মোট ১০৯জন রোগীর বিভিন্ন রোগের প্রেক্ষিতে ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ি মেডিকেল ক্যাম্প এ বিভিন্ন রোগের জন্য ফ্রি ওষুধ সেবার ও ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও রোগীদের ফ্রি ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিকস টেস্ট এবং ওজন মাপার ব্যাবস্থাও ছিল উক্ত মেডিকেল ক্যাম্প এ। ৭ জন গর্ভবতী নারী এই ক্যাম্পটির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছেন ।
উক্ত স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প থেকে বেশিরভাগ বাচ্চার ঠান্ডা জ¦র, পেট খারাপ এবং অপুষ্টিজনিত কারণে, বয়স্করা নানাবিধ শারীরিক সমস্যা নিয়ে এবং নারী এবং কিশোরী মেয়েরা এসেছিলেন তাদের গাইনী সমস্যা নিয়ে। বস্তির ইয়ানুর আপা বলেন, ‘একজন ভাল ডাক্তার দেখাতে কমপক্ষে ১০০০ টাকা লাগে, তারপর ওসুধ টেস্ট ইত্যাদি মিলিয়ে আরও ১০০০ টাকা, কমপক্ষে দুই হাজার টাকা লাগে। আজকে এখানে এসে টেস্ট করাতে না পারলেও আমার কমপক্ষে ১২০০-১৫০০ টাকা বেঁচে গেল।” সকলেই বারসিক’র এই আয়োজনকে অনেক স্বাধুবাদ জানিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে এরকম ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প যেন আরও করা হয় সে বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন।