প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় সবুজ সংহতি গঠন
রাজশাহী থেকে মো: আতিকুর রহমান আতিক
রাজশাহীর প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় নাগরিক ভাবনা ও সবুজ সংহতি বিষয়ক আলোচনা ও মতবিনিময় সভা গতকাল নগরীর একটি রেস্তোরায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজশাহীর যুব/যুবাদের বৃহৎ ঐক্য বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরাম ও গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ (বারসিক) এর যৌথ আয়োজনে নগরীর বোয়ালিয়া থানাধীন রিফ্রেশমেন্ট রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত হয়।
বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের সভাপতি শাইখ তাসনিম জামাল এর সঞ্চালনায়, শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বারসিক’র আঞ্চলিক সমন্বয়কারী, গবেষক শহিদুল ইসলাম। বক্তারা বলেন, ‘প্রাকৃতিক পরিবেশ, কৃষিপ্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করা এবং জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা বর্তমান পরিবর্তিত সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের সীমাহীন লোভের কারণে আজ প্রকৃতির অন্যান্য সৃষ্টি (প্রাণি, বৃক্ষ, লতা-পাতা), পাহাড়, বন, নদ-নদী জলাশয়-জলাধার সবই ভয়াবহ বিপন্নতার পথে। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল সৃষ্টির সেরা ‘জীব’ বলে দাবিদারদের একটি শক্তিশালী অংশ (অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতায় দাপটে কোন কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশ) এই বিপন্নতা তৈরির জন্য দায়ী। বর্তমানে মানুষের এসব কর্মকান্ডের কারণে বিপর্যস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ যা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক ধারাকে। এর ফলে প্রকৃতি নির্ভর মৌসুমভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার উপর পড়ছে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব, যা আমাদের দেশের মত প্রকৃতিনির্ভর গ্রামীণ আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে নানামাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দেশের কৃষকদের পক্ষে ঋতুভিত্তিক ফসল চাষ পঞ্জিকা অনুসরণ করে ফসল চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। বন্যা, খরা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রতিনিয়ত সামাল দিতে হচ্ছে। খরা প্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলও এর বাইরে নয়। এখানে দিনে দিনে তীব্র তাপপ্রবাহ, অনাবৃষ্টি, খরা এবং সেই সাথে কৃষিতে অধিক রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারের কারণে বরেন্দ্র বাস্তুসংস্থান বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে। শুধু গ্রামে নয়, এর প্রভাব পড়ছে নগরেও এবং নগর পরিবেশ প্রতিবেশও দিনে দিনে মারাত্বক বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে।
বারসিক এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী, গবেষক শহিদুল ইসলাম বলেন, “বর্তমান সরকার দীর্ঘ সময়ে উন্নয়ন কাজ পরিচালনার কারণে নানামূখী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় পরিবেশবান্ধব উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছেন। একই সাথে প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধান (ন্যাচার বেজ সল্যুউশন ও ডেভেলপমেন্ট) ও উন্নয়নের প্রতি তিনি বারবার গুরুত্ব তুলে ধেেরছন। কিন্তু স্থানীয়ভাবে আমরা দেখছি সামান্য কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে উন্নয়নের নামে বৃক্ষ হত্যা, পুকুর ভরাট, প্রাকৃতিক জলাধার বিনষ্ট করছে। যার ফলে নগরের পাখি কমে গেছে, নগরের তাপমাত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। নগর বাস্তুসংস্থানে (ইকোসিস্টেম) বিপর্যয় দেখা গেছে”। হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি, নদী ও পরিবেশ গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, “এই নগরে পরিবেশবাদী এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে যেসকল সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাদের মধ্যে ঐক্য এবং পরিবেশ উন্নয়নে যৌথ সমন্বয় থাকা দরকার। এ লক্ষ্যেই রাজশাহী মহানগরীর প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় একটি সবুজ সংহতি (গ্রীণ কোয়ালিশন) প্রয়োজন। যার উদ্দেশ্য হতে পারে- মানুষকে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনাশী কর্মকান্ড থেকে বিরত করা, যাতে প্রকৃতিতে বসবাসরত সকল প্রাণ সুরক্ষিত থাকে।’ সেভ দি ন্যাচার এন্ড লাইফ এর চেয়্যারম্যান মিজানুর রহমান মিজান বলেন, “মাটি, পানি, বায়ুসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের দূষণ বন্ধ করতে হবে। শুধু কংক্রিটের আস্তরণ আর সুউচ্চ ভবন নয়; মানুষসহ সকল প্রাণের জন্য বাসযোগ্য একটি নগর গড়ে তুলতে হবে এবং একইসাথে জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয়, জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে সম্মিলিত সামাজিক জনআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’
ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, সেকেন্দার আলী বলেন, “মাটি, পানি, বায়ুসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের দূষণ বন্ধ করা এখনই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।” বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন এর সাধারণ সম্পাদক নাদিম সিনা বলেন, “রাজশাহী নগরের প্রান্তিক মানুষের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শহরের রাস্তায় আমরা দেখি প্রচুর আলো কিন্তু শহরের অদুরেই বিভিন্ন বস্তিতে দেখা যায় তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, রাজশাহী শিক্ষানগরী অথচ তারা শিক্ষা নগরীতে থেকেও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।’ জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সূভাস চন্দ্র হেমব্রম বলেন, “শুধু মানুয় নয়, সকল প্রাণের প্রাণের জন্য বাসযোগ্য নগর তৈরী এবং নগরের মানুষের নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় কৃষিপ্রতিবেশকে উন্নয়ন ও সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করাও এই নগরের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের দায়িত্ব।’
ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস’র সাধারণ সম্পাদক ও বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক বলেন, “নগরীর খোলা জায়গা, খেলার মাঠ, পুকুর-দিঘি, জলাশয়-জলাধারগুলো ভরাট করে বড় বড় ভবন ও বিপনীবিতান তৈরি করা হয়েছে। এসব তৈরির আগে পরিবেশের উপর কি প্রভাব পড়বে সেগুলো বিবেচনায় নেয়া হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, “বৃক্ষ, পাখি, পুকুর দিঘি, প্রাকৃতিক জলাধারসহ নিজস্ব সংস্কৃতি সুরক্ষা করেই হোক সকল উন্নয়ন।” পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের সভাপতি মাহবুব টুংকু বলেন, “মনুষ্যসৃষ্ট কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব আজ চরম হুমকির মধ্যে। এত বিপন্নতার মধ্যেও প্রকৃতি বিনাশী কর্মকান্ড থেকে মানুষ এখনও বিরত হয়নি। তাই তো প্রতিদিন নতুনভাবে ও নতুন কৌশলে প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। এর সর্বশেষ ভয়াবহ পরিণতি পরবর্তী প্রজন্মকে বহন করতে হবে। তবে এ বিপন্নতার মাঝেও এখনও আশার আলো দেখা যায়। গ্রাম-শহরে এখনও অনেক প্রকৃতি-পরিবেশ দরদী সচেতন মানুষ, শিক্ষার্থী, যুবরা প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায় জোটগত বা নিজ উদ্যোগে এগিয়ে আসছেন, আন্দোলন করছেন এবং পরিবেশ- প্রকৃতি সুরক্ষায় সচেতন করছেন অন্যদেরকেও।”
প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষা,খাদ্য সার্বভৌমত্ব এবং জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় রাজশাহী মহানগরীতে গ্রীণ কোয়ালিশন গঠন এবং এ সম্পর্কি সমন্বিত নাগরিক কার্যক্রম শুরু এখন সময়ের দাবি। আর তাই নদী ও পরিবেশ গবেষক, লেখক মাহবুব সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক এবং পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল ইসলাম রাজুকে সদস্য সচিব করে সবুজ সংহতি (গ্রীন কোয়ালিশন) এর আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষায় উদ্যোগী ব্যক্তি ও সংগঠন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, প্রতিনিধি, সচেতন ব্যক্তি ও সংগঠনকে গ্রাম-শহরে আঞ্চলিক এবং জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করে “সবুজ সংহতি” (গ্রীন কোয়ালিশন) তৈরি করা হবে।
রাজশাহীর প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় নাগরিক ভাবনা ও সবুজ সংহতি বিষয়ক আলোচনা ও মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য প্রদান করেন, ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস’র সভাপতি শামীউল আলীম শাওন, গ্রীন ভয়েস রাজশাহীর বিভাগীয় সহ সমন্বয়ক আব্দুর রহিম, মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক ওয়ালিউর রহমান বাবু, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের প্রচার প্রকাশনা সম্পাদক তানজিলা আক্তার, স্বচ্ছলতা এসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক সালমান ফার্সী, মাসুম মাহবুবসহ প্রমুখ।