কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যার চর্চা প্রচারে বারসিক
নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান
প্রতিবছরের ন্যায় কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যার উপর বিশ্বব্যাপী প্রচারের জন্য অক্টোবর মাসের ১ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক ও কৃষক কৃষাণি সংগঠনগুলো। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো: কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা আমাদের জলবায়ু সংকট সমাধান করে। গ্রামীণ যুবক ও নারীদের ভবিষ্যৎ খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করে।’ কাজের ধারাবাহিকতায় সচেতনতা তৈরির জন্য বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি শীলতপাটি সংগঠন, বালুয়াকান্দা রাখালবন্ধু ও ফুলপাখি কিশোরী সংগঠন, হাসামপুর গ্রামের মিলেমিশে কাজ করি নারী সংগঠন, অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠন, কলমাকান্দা উপজেলার বনবেড়া গ্রামের বনলতা আদিবাসী নারী সংগঠন, আটপাড়া উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামের কৃষাণি সংগঠন নিরাপদ খাদ্যমেলা, অচাষকৃত খাদ্যসম্পদ কর্মশালা মেলা, কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা চর্চা, জলবায়ু ন্যায্যতাও কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা, প্রাকৃতিক কৃষি, রাসায়নিক কৃষিকে না বলি, পারিবারিক কৃষি চর্চা করি শীর্ষক আলোচনা, খাদ্যসার্বভৌমত্ব কর্মশালা, ছবি প্রদর্শনী, কৃষক বন্ধন এর আয়োজন করে।
৮ অক্টোবর কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যার উপর বিশ্বব্যাপী প্রচারের জন্য নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি শীতল পাটি সংগঠনের নারী কিশোরী মিলে আলোচনা, ছবি প্রদর্শনী ও বীজবিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। গ্রামের ৩৫ জন কৃষাণির মাঝে শীতকালিন সবজি বীজ বিতরণ করা হয়।
৯ অক্টোবর কর্মসূচির অংশ হিসেবে বালুয়াকান্দা গ্রামে রাখালবন্ধু কৃষক সংগঠনের উদ্যোগে কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা শিখন কেন্দ্রে যুব কিশোরী, নারীদের অংশগ্রহণে “খাদ্যসার্বভৌমত্ব” বিষয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। নারীরা অচাষকৃত শাকসবজি, স্থানীয় বীজ, নিরাপদ খাদ্য প্রদর্শন করেন এবং ফটো প্রদর্শন করেন। কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কৃষক আবুল কালাম। প্রত্যেক নারী-পুরুষ কিশোরী নিজ নিজ পছন্দের খাবারের কথা জানান ও নিজ বাড়িতে উৎপাদন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। গ্রামের নারীরা ৩০ নারীর মাঝে লাউ, সীম, লালশাক, মুলা শাক, ডাটা শাকের বীজ বিতরণ করেন।
১৩ অক্টোবর গ্রামীণ নারীপুরুষ যুবরা মিলে জলবায়ু সংকটের কারণে গ্রামীণ কৃষকের খাদ্য সংকট ও নানা প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে খাদ্য উৎপাদন করে তার বিবরণ তুলে ধরেন। চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামে নারীপুরুষ মিলে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বালি জমিতে দাঁড়িয়ে জলবায়ু বন্ধন ও খাদ্য অধিকার নিয়ে আলোচনা করেন।
১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস পালন করা হয়। এবছরের প্রতিপাদ্য হলো: কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা আমাদের জলবায়ু সংকট সমাধান করে। গ্রামীণ যুবক ও নারীদের ভবিষ্যৎ খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর গ্রামে আইপিএম ক্লাবের আয়োজনে বীজবিতরণ, আলোচনা ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে গ্রামীণ নারীর অবদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
তাছাড়া কলমাকান্দা উপজেলায় উত্তর লেংগুরা গ্রামে গৃহলক্ষ্মী কৃষানি সংগঠনের উদ্যোগে স্থানীয় জাতের ৮ জাতের বীজ ৫৮ জন আদিবাসী নারীর কাছে বিতরণ করা হয়। নারীদের অংশগ্রহণে নিরাপদ খাদ্যের প্রচারণা চালানো হয়।
১৬ অক্টোবর নেত্রকোনা সদর উপজেলার হাসামপুর গ্রামে মিলেমিশে কাজ করি কৃষাণি সংগঠনের উদ্যোগে হাজল তৈরির কর্মশালা, আলোচনা, খাদ্যমেলা ও ছবি প্রদর্শন করা হয়। বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে বারসিক’র সহযোগিতায় ও নেত্রকোনা সদর উপজেলার উত্তর হাসামপুর গ্রামের মিলেমিশে কাজ করি নারী সংগঠন ও গ্রামবাসীর এবং কলমান্দা উপজেলার খারনৈ ইউনিয়নের বনবেড়া গ্রামের বনলতা নারী সংগঠনে উদ্যোগে বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপন করা হয়। এবছরের প্রতিপাদ্য হলো: ‘উন্নত জীবন ও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করি।’
দিবসটি উদযাপনের জন্য অচাষকৃত খাদ্যমেলা, হাজল কর্মশালা, বীজ বিতরণ, আলোচনার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নেত্রকোনায় মেলাটি উদ্বোধন করেন হাসামাপুর গ্রামের প্রবীণ নারী (৭৫) খালেদা আকতার। আরো উপস্থিত ছিলেন, ডা. মানিক চন্দ্র সরকার, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তাসলিমা সুলতানা। মেলায় হেলেঞ্চা, কলমীশাক, ঢেকিশাক, তেলাকুচি, দুধকচু, বেতপাতা, তিত বেগুন, গিমা, মাসরুম, থানকুনি, সাজনা পাতা, শালুক, শাপলাসহ ২৪ জাতের খাবার প্রদর্শন করা হয়। নিরাপদ মুরগির ডিম ফোটানোর জন্য হাজল তৈরির প্রশিক্ষণ ও হাজল প্রদর্শন করা হয়। মেলায় অচাষকৃত নিরাপদ বিষমুক্ত এসব পছন্দের খাবার নিয়ে প্রত্যেক নারী ও পুরুষ শিশু তার মতামত তুলে ধরেন। গ্রামের কৃষক মুর্তুজ আলী বলেন, “আমার পছন্দের খাবার হলো বিরই ধানের চালের ভাত, শিং ও কৈ মাছ। আমি আমার পছন্দের খাবার খেতে চাই।” কিশোর ইলমা বলেন, ‘আমি শালুক পছন্দ করি।’
কলমান্দা উপজেলার খারনৈ ইউনিয়নের বনবেড়া গ্রামের বনলতা নারী সংগঠনে উদ্যোগে বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপন করা হয়। মেলা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। মেলায় মোট ১২টি স্টলে বৈচিত্র্যময় ৫০টি অচাষকৃত খাদ্য প্রদর্শিত হয়। যেমন-জংলী কচু, গাচলী, লম্বা শামুক, জংলী লতা, শাপলা, জংলী কলার থোর, কলা গাছ, বড় শামুক, ছোট শামুক, ঝিনুক, কচুরিপানা, কাকড়া, তাবুরী, চংগী, বাঁশকুড়ল, কচুমুখী, মানকচু, ফাওয়াংগা, জংলী টকপাতা, ফাসিম, তিত বেগুন, গিমা, মাসরুম, থানকুনি, কাক্কুচী, রিফুজি পাতা, কানথাপ, খিরিং, বাসক, মিগং, মিবিচী, গানজেদ, স্থেং, কারিক্ষা, বিকি তিত্তা, চুনচুনি পাতা, টকলে পাতা, পাহাড়ি আলু, মিক্রাম, তেলাকুচি, দুধকচু, বেতপাতা, খাসিয়া মেন্ডা, দংকেলে, সেরেংকি, খেতাবরি।
এই প্রসঙ্গে ভিক্টর ডিব্রা বলেন, “ আমাদের পছন্দের খাবার দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।” মেলা ও আলোচনায় আরো উপস্থিত ছিলেন, গুঞ্জন রেমা, সহযোগী আঞ্চলিক সমন্বয়কারী শংকর ¤্রং, খাদিজা আকতার, গুঞ্জন রেমা, আলপনা নাফাকসহ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তাসলিমা সুলতানা বলেন, “সকল প্রাণের খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত হোক, তবে আমাদের নিরাপদ খাদ্যের জন্য কাজ করতে হবে। প্রাকৃতিক যেসব খাবার আছে সেগুলোর উৎস আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে”।
এছাড়া আটপাড়া উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে বিশ্ব খাদ্যদিবসে খাদ্যমেলার আয়োজন করা হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা ফয়জুন নাহার নিপা, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ওমর ফারুক।