লেবু সানাউল্লাহ
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে আবার কেউ কেউ শখের বসে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করেন। এক্ষেত্রে কেউ সফল হন আবার কেউ বিফল হন। কিন্তু তাই বলে কেউ হাল ছেড়ে দেন না। সময় ও অর্থ ব্যয় করে এবং এলাকায় ও এলাকার বাইরের পরিচিত ব্যক্তিদের সহযোগিতা নিয়ে একসময় তারা সফলতার মূখ দেখেন। নেত্রকোনা সদর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের মদনপুর গ্রামের এমনই একজন উদ্যোগী ব্যক্তি মো. সানাউল্লাহ (৪২)। পেশায় কৃষক সানাউল্লাহ পাঁচ ভাই-বোনের (৪ ভাই ও ১ বোন) মধ্যে সবার ছোট। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি, তাই বাবার হাত ধরে কৃষি কাজে যুক্ত হন।
সানাউল্লাহ কৃষি কাজ করলেও তিনি সবসময় মনের মত একটি বাগান বাড়ি তৈরির স্বপ্ন মনে লালন করে এসেছেন। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি নিজের মত করে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। বিভিন্ন জাতের লেবু চারা ও অন্যান্য ফলের চারা সংগ্রহ করে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন একটি বাগান বাড়ি। তিনি বাড়িতে বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়মিত বৈচিত্র্যময় লেবু ও ফলের চারা রোপণ করেন। তেমন পুঁজি না থাকায় পছন্দের জাতের লেবুর চারা ও অন্যান্য ফলের চারাও কেনা সম্ভব হচ্ছিল না। একদিন শুশুর বাড়ির গ্রামে লেবু বাগান দেখে নিজ বাড়িতে অনুরূপ একটি বাগান করার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেন সানাউল্লাহ। পরিবারের সকলের সাথে পরামর্শ করে পুকুর পাড়ের জমিসহ ৭০ শতাংশ জমিতে আরম্ভ করেন ফলের বাগান সৃজনের কাজ। ৩০০টি এলাচী লেবুর চারা সংগ্রহ করে রোপণ করেন বসতভিটার সে জমিতে। লেবুর সাথী ফসল হিসেবে রোপণ করেন পেঁপে। এটি ২০১৩ সালের কথা।
লেবুর চারা রোপণের দুই বছর পর ২০১৫ সালে তিনি প্রথমবারের মত ১০ হাজার টাকায় লেবু বিক্রি করেন। তারপর ২০১৬ সালে সর্বমোট ৮০ হাজার টাকার লেবু বিক্রি করেন। বাড়ির চারপাশে লেবু বাগান গড়ে তোলার বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমে কলার বাগান করার চিন্তা করেছিলাম, কিন্তু গ্রামের অনেকে, বিশেষভাবে মুরব্বীরা আমাকে কলা বাগান না করে লেবু বাগান করার পরামর্শ দেন। গ্রামের অভিজ্ঞ লোকদের পরামর্শে বাজারে কলার চাহিদা দর যাচাই করে দেখি কলার চেয়ে লেবুর বাজার দর বেশি। শেষ পর্যন্ত গ্রামের অন্য কৃষকদের পরামর্শে লেবুর বাগানই করার জন্য মনোস্থির করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘লেবু চাষি অভিজ্ঞ কৃষদের নিকট লেবু চাষের সুবিধাগুলো (লেবু বাতাসে ঝড়ে পরে না, লেবুতে পোকার আক্রমণ তেমন না হওয়ায় কোন প্রকার কীটনাশকও প্রয়োগ করতে হয়না) জানার পর আমি লেবু বাগান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। সবার পরামর্শে আমি লেবুর বাগান গড়ে তোলায় সফল হয়েছি। শুকনা মৌসুমে পানি বাগানে পানি সেচের সুবিধার জন্য লেবুর গাছের দুই সারির মাঝে ড্রেন করে দিয়েছি। সারাবছরই আমি লেবুর বাগান থেকে লেবু সংগ্রহ করতে পারছি, লেবু বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছি।’
সানাউল্লাহ’র বাগান সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায়, বাগানের অধিকাংশ লেবু গাছই বারমাসি হওয়ায় তিনি বছরের সারামাসই কম বেশি লেবু বিক্রি করতে পারেন। সরেজমিনে দেখা যায়, বাগানের অধিকাংশ গাছেই পরিপক্ক ও অপরিক্ক লেবু রয়েছে, অন্যদিকে একই গাছে অসংখ্য ফুল ও কড়া ধরছে। বারোমাসি এই লেবুটি (পাতি লেবু) তিনি তার চাচার বাড়ি থেকে ডাল এনে রোপণ করেছিলেন বলে জানা যায়। বসতভিটার চারপাশে লেবুর গাছ রোপণ করায় এক দিকে তা’ যেমন বসতভিটার বেড়ার কাজ করছে, অন্যদিকে সারাবছর ফল বিক্রি করে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করতে পারছেন। বর্তমানে তার মোট ৭০ শতাংশ জমিতে লেবুর বাগান রয়েছে। লেবু বিক্রি করে চলতি মৌসুমে তিনি খরচ বাদে প্রায় লক্ষাধিক টাকা আয় করেছেন। আগামী মৌসুমে লেবু থেকে আয় আরও বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশা করছেন।
লেবুর বাগানে সাথী ফসল হিসেবে ৭০টি পেঁপে চারা রোপণ করেছেন। সারাবছর পরিবারে সবজির চাহিদা ও ফলের চাহিদা মিটিয়েও তিনি ৭০টি গাছের পেঁপে বিক্রি করে এ বছর আয় করেছেন পাঁচ হাজার টাকা।
শুধু লেবু বিক্রি করেই তিনি থেমে থাকেননি। লেবুর বাগানটি আরো সম্প্রসারিত করতে বর্তমানে তিনি নার্সারিতে লেবুর চারা উৎপাদন করছেন। উৎপাদিত লেবুর চারা তিনি বাজারে বিক্রিরও উদ্যোগ নিয়েছেন। চলতি বছর তিনি নার্সারিতে মোট ৩৫০০টি লেবুর চারা (কলম) উৎপাদন করেছেন। নিজের বাগানে রোপণের পর উদ্বৃত্ব চারা তিনি বাজারে বিক্রি করবেন বলে জানান। লেবুর চারার পাশাপাশি নার্সারিতে তিনি আম ও কাঁঠালের চারাও উৎপাদন করছেন। নার্সারি গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি দুই বছর আগে বিভিন্ন জাতের ৪৩টি আমের চারা রোপণ করেছিলেন। সেই আম গাছে ফল ধরেছে এবং নিজেরা আম খেয়েও প্রায় শ’ খানেক আম তিনি বিক্রি করেছেন বলে জানান। সেই আম গাছগুলোর ডাল সংগ্রহ করে নার্সারিতে এ বছর তিনি ৫০টি আমের গ্রাফটিং চারা করেছেন।
একটি পরিকল্পিত, সুসজ্জিত, গোছালো, বৈচিত্র্যময় ফলদ গাছ-গাছালীর এক বিরাট সমরোহ যেন সানাউল্লার বাড়ি। তিনি এ সবকিছুই করছেন তার মনের তাগিদ থেকে গাছ-গাছালিকে ভালোবেসে। গাছের অন্তরালে নিজেকে সার্বক্ষণিক আবিষ্কার করতে চান এই কর্মঠ উদ্যমী ব্যক্তিটি। অলসতার সব গ্লানি কাটিয়ে সফল হতে চান, হতে চান একজন বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। এটাই তার আশা-প্রত্যাশা। জীবনের অনেক সংকটময় সময় তিনি পারি দিয়েছেন একে একে। আর তা’ সবই সম্ভব হয়েছে নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম, ধৈর্য এবং লক্ষ্য অর্জনের একাগ্র মনোনিবেশ ও ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে। আজও সফলতার পরিপূর্ণ স্বাদ তিনি তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করতে পারেননি বলে জানান। তবে আশা করছেন, খুব শীঘ্রই সেই স্বাদ তিনি পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে উপভোগ করতে পারবেন।
বাগানে চাষকৃত লেবু, আম ও পেঁপের বীজ সংগ্রহ করে নার্সারিতে এগুলোর চারা উৎপাদন করে সানাউল্লাহর এলাকার সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চান। এলাকার কৃষক ও উদ্যোগী মানুষদের মধ্যে ভালো জাতের ও উন্নত মানের ফলের চারা নিশ্চিত করাই তাঁর নার্সারি গড়ে তোলার অন্যতম লক্ষ্য। সানাউল্লার দেখাদেখি এলাকার অনেক কৃষক ও বেকার যুবক তাঁর নিকট পরামর্শ নিতে আসছে। কেউ কেউ তার নিকট থেকে চারা সংগ্রহ করে বাড়িতে লেবুর চারা রোপণ করছেন। আবার অনেকে লেবুর চারা কেনার জন্য অর্ডার দিয়েছেন। লেবু, আম ও পেঁপের চাষ করে সানাউল্লাহ এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। তবে তিনি এসব ফলের বাগান করে পরিবেশ সংরক্ষণে যে পরিমাণে অবদান রেখে চলেছেন তা টাকায় পরিমাপযোগ্য নয়।