নেত্রকোনায় আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াড
ঢাকা থেকে সৈয়দ আলী বিশ্বাস
পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে ইতিমধ্যেই পৃথিবী বিভিন্ন দেশ নানাভাবে তাদের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, বাংলাদেশ তার অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ‘বৃক্ষ’ শুধুমাত্রা হাতিয়ারই নয় আমাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ তথা অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ জীবনধারনের প্রতিটি পর্যায়ে বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই বৃক্ষবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধিকরণে জনসচেতনতা তৈরি, তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ ও সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে নেত্রকোনা অঞ্চলের যুব সমাজের সম্মিলিত সংগঠন- ‘নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজ’ ও গবেষণাধর্মী উন্নয়ন সংগঠন বারসিক নেত্রকোনা এলাকায় যৌথভাবে আয়োজন করে ‘নেত্রকোনা আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াড-২০১৮’। জানা মতে, বৃক্ষ নিয়ে এধরনের উদ্যোগ সারা দুনিয়াতেই প্রথম যা বারসিক’র উদ্যোগে গতবছর বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহী জেলায় প্রথম শুরু হয়। নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজ ও বারসিক’র এই ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বিভিন্নভাবে উৎসাহ ও সহযোগিতা করেন নেত্রকোনা এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, সাংবাদিক, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন।
নেত্রকোনায় বারসিক
পাহাড়ের পাদদেশ লেহন করে এঁকেবেঁকে কংশ্ব, সমেশ্বরী, গোরা উৎরা, মগড়াসহ নানা নদীর শাখা, প্রশাখা, কলমাকান্দা, দুর্গাপুরের পাহার টিলা, জলাভুমি মিলে সকল প্রাণের খাদ্যের অফুরন্ত ভান্ডার নিয়ে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার উদ্ভব। যুগ যুগ ধরে পানি প্রবাহের কারণে প্রাকৃতিকভাবে পলিযুক্ত উর্বর জমির ফসল ও জলাশয়গুলোতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন মাছের অবাধ বিচরণ ভাটি বাংলা হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলকে দিয়েছে এক অনন্যতা। বাঙালির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উর্বর ভূমি প্রাকৃতিক মাছের প্রাপ্তিস্থলের কাছাকাছি থাকা। অনুমান করা হয় এইসব প্রাকৃতিক সম্পদের সহজ প্রাপ্ততার কারণেই এই এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠে। তাই তো এই এলাকায় বসবাসকারী মানুষের যাপিতজীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে প্রাণ-প্রকৃতির এক সমৃদ্ধ ইতিহাস।
প্রাণসম্পদকেন্দ্রিক এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ জীবন সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে আগ্রহী করার তাগিদ থেকেই বারসিক ও নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজ আয়োজন করে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ট্রি অলিম্পিয়াড। দেশের প্রতিটি প্রতিবেশীয় এলাকার প্রাকৃতিক ও সংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতাকে ধারণ করে গণমানুষের অভিজ্ঞতানির্ভর জ্ঞান দক্ষতা ও চর্চাকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন কৃষি প্রতিবেশ এলাকায় কাজ করে গবেষণাধর্মী বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন বারসিক। যার প্রতিটি পদক্ষেপে যুক্ত থেকেছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের কৃষক-কৃষাণী-জেলে-তাঁতী-কামার-কুমার-হরিজন-কারুশিল্পী-কবিরাজ-বনজীবী-মাওয়ালী-বাউয়ালীসহ প্রকৃতি নির্ভর পেশাজীবী মানুষ ও আগ্রহী যুব সমাজ। একটি বহুত্ববাদী সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক শক্তি হিসেবে বারসিক এক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছে মানুষের সাথে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের সম্পর্ক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আন্তঃনির্ভশীল সম্পর্ক, পরিবেশ প্রতিবেশগত ভিন্নতা, প্রকৃতিনির্ভর মানুষের অধিকার, জলবায়ুগত পরিবর্তশীলতার সাথে স্থানীয় মানুষের টিকে থাকার নিজস্ব কৌশল ও সক্ষমতাকে।
নেত্রকোনা আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াডের শুভ উদ্বোধন
কবি মহাদেব সাহা’র ‘এ জীবন আমার নয়’ কবিতা থেকে নেয়া “এই যে দেখছো জীবন এ জীবন আমার নয়, আমি বেঁচে আছি বৃক্ষের জীবনে” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে বারসিক ও নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজ ৮ এপ্রিল ২০১৮ নেত্রকোনা জেলার লক্ষীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুল পর্যায়ে ট্রি অলিম্পিয়াডের উদ্বোধনী আনুষ্ঠান আয়োজনের ভেতর দিয়ে শুরু হয় নেত্রকোনা আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াড ২০১৮ এর যাত্রা।
লক্ষ্মীগঞ্জ স্কুলের শিক্ষার্থীদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বর্ণাঢ্য এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন। ৮এপ্রিল ২০১৮ এ শুরু হওয়া ট্রি অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে জেলার মোট ৫২টি স্কুলের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। প্রাথমিক বাছয়ের পরে অংশগ্রহণকৃত ৫২টি স্কুলের মোট ৫৪৬৮জন শিক্ষার্থী স্কুল পর্যায়ে আয়োজিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিটি স্কুল থেকে মোট ৫জন শিক্ষার্থীকে আঞ্চলিক পর্যায়ে অংশগ্রহণের জন্য ‘ইয়েস কার্ড’ প্রদান হয়। প্রতিটি স্কল থেকে ‘ইয়েস কার্ড’ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা ২৪ অক্টোবর আয়োজিত নেত্রকোনা আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে।
স্কুল পর্যায়ে আয়োজিত ট্রি অলিম্পিয়াডের পরীক্ষা পদ্ধতি
প্রাথমিকভাবে বাছাইয়ের পরে অগ্রহী শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিটি স্কুলে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বৃক্ষ সম্পর্কিত মোট ২৫টি প্রশ্ন প্রদান করা হয়। প্রতিটি প্রশ্নের জন্য চারটি উত্তর দেয়া থাকে সেখান থেকে সঠিক উত্তরটি নির্বাচন করতে বলা হয়। এই ভাবে ৫২টি স্কুলে মোট ১১দিনে ১১টি ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন সেটের মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়া হয়। পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি জন্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক, লেখক, সংবাদিক, কবিরাজ, বৃক্ষপ্রেমিক, যুব সমাজ, কৃষকদের কাছে থেকে প্রশ্ন আহবান করা হয়। সকলের প্রশ্ন থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি পরীক্ষার আগের দিন পরীক্ষার জন্য প্রশ্ন সেট চুড়ান্ত করে। কমিটির তদারকিতেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশ্ন প্রিন্ট করে পরীক্ষার আধাঘণ্টা আগে প্রতিটি প্ররীক্ষা কেন্দ্রে নিষ্ঠাবান যুব স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়।
কাজটি অত্যন্ত সতর্কতা ও নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করায় পুরো অলিম্পিয়াডের একটি পরীক্ষাতেও কোন প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস হয়নি। এই অলিম্পিয়াডের অন্যতম একটি সাফল্য এটি। বর্তমানে বাংলাদেশে পরীক্ষার আগে যেভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এই অলিম্পিয়াডে পরীক্ষা প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই বিশেষ করে যুব সমাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার পরিচয় দিয়েছে। প্রতিটি স্কুলে পরীক্ষা শেষে শুরু হয় প্রশ্নত্তোর পর্ব। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা বৃক্ষ বিষয়ে জানার জায়গা থেকে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে থাকে যার উত্তর দেন প্রতিটি পরীক্ষা কেন্দ্র উপস্থিত বিশেষজ্ঞ পানেল। প্রশ্নত্তোর পর্ব শেষে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রতিটি স্কৃুল থেকে প্রথম পাঁচজনকে নেত্রকোনা আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জনস্বরূপ ‘ইয়েস কার্ড’ প্রদান করা হয়।
ট্রি অলিম্পিয়াড শুধু প্রতিযোগিতা নয়, একটি উৎসব
ট্রি অলিম্পিয়াডকে সামনে রেখে প্রতিটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র একটি প্রতিযোগিতায় নামেনি। বরঞ্চ শিক্ষার্থীরা বৃক্ষ সম্পর্কিত, গান, কবিতা, নাটক, আলোচনা, স্কুল আঙ্গিনায় বৃক্ষরোপণ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটিকে একটি উৎসবে রূপ দিয়েছেন।
যেখানে স্কুলের সকল শিক্ষার্র্থীরা বৃক্ষ সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের নিজ পছন্দ অনুযায়ী কোন না কোনভাবে এটিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। এছাড়া অনুষ্ঠানগুলো আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্যনির্ভর কোন অনুষ্ঠানও ছিলনা। বিষয়কে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা যে যেভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে সেটিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ফলে এই উৎসবের ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীরা রচনা করেছেন গান, নাটক, কবিতা ও ছড়া। এছাড়া স্কুল পর্যায়ে প্রতিটি আয়োজন শেষে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রোপণ করেছেন বিভিন্ন ধরনের হাজার হাজার ফলজ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষ।
সেই দিক থেকে শিক্ষার্থীরা ট্রি অলিম্পিয়াডকে সামনে রেখে বাস্তবায়ন করেেেছন একটি কার্যকরি বৃক্ষরোপণ অভিযান, যে অভিযানে বিনা পয়সায় হজার হাজার চারা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন নেত্রকোনা জেলার আরেক বৃক্ষপ্রেমিক কৃতি সন্তান কবিরাজ আব্দুল হামিদ। তাই নেত্রকোনা এলাকায় যুবদের হাত ধরে আয়োজিত এই ট্রি অলিম্পিয়াডকে বলা যায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বৃক্ষরোপণ ও রক্ষায় উৎসবমুখর এক গণজাগরণ।
নেত্রকোনা আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াডের চুড়ান্ত পর্ব
নেত্রকোনা জেলার রাজুর বাজার কলেজিয়েট স্কুল এ্যান্ড কলেজে বারসিক ও নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজের উদ্যোগে নেত্রকোনা আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াড ২০১৮ এর চুড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। স্কুল পর্যায়ে আয়োজিত নেত্রকোনা জেলার ৫২ স্কুলের নির্বাচিত ২৬০ জন শিক্ষার্থীরা এতে অংশগ্রহন করে।
জাতীয় সংগীত ও পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বরেণ্য কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক যতীন সরকার। ৫২টি স্কুলের ২৬০ জন শিক্ষার্থী চুড়ান্ত পর্বে ৫০ নম্বরের ৫০টি প্রশ্নের উত্তর দেন।
পরীক্ষা শেষে আয়োজিত প্রশ্নত্তোর পর্বে শিক্ষাথীদের গাছ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য প্রশ্নত্তোর পর্বে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আ. খ. ম. গোলাম সারওয়ার, রাজুর বাজার কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা, আবু আব্বাস কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজমুল কবির খান, আটপাড়া শিক্ষা সংস্কিৃতি বৈচিত্র্য রক্ষা টিমের আহবায়ক ও প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুল হালিম খান ও আব্দুল হামিদ কবিরাজ। প্রশ্নত্তোর পর্ব শেষে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি স্কুলের শিক্ষার্থী ও আমন্ত্রিত অতিথিরা নিজ নিজ স্কুল ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ্যে রাজুর বাজার কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজ মাঠে স্মৃতি স্বরূপ একটি করে দেশীয় গাছের চারা রোপণ করেন।
ট্রি অলিম্পিয়াডে উদ্ভিদ বৈচিত্র্য মেলা ও শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ট্রি
আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াডকে সামনে রেখে নেত্রকোনা এলাকার কৃষক-কৃষাণী, যুব সমাজ ও করিরাজগণ তিনটি মনোমুগ্ধকর উদ্ভিদ বৈচিত্র্য প্রদর্শনী দেন। এলাকার কৃষকরা ৩৭৫টি স্থানীয় জাতের ধানের বীজসহ এলাকায় চাষকৃত বিভিন্ন ধরনের ফসলের বীজ প্রদর্শন করেন। সেই সাথে কৃষকরা প্রদান করেন নেত্রকোনা এলাকার ১৬ ধরনের মাটি। নারীরা প্রদর্শন করে ৮১ ধরনের অচাষকৃত উদ্ভিদ যেগুলো গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন ঔষধ ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সেই সাথে নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজের উদ্যোগে প্রদর্শিত হয় নেত্রকোনা জেলায় প্রবহমান ৪০টি নদীর পানি। এই প্রদর্শনীর ভেতর দিয়ে তারা মূলত এলাকার তরুণ প্রজন্মকে নেত্রকোনা এলাকার সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্য রক্ষায় জনমানুষের নিরন্তর লড়াইকে তুলে ধরেছেন। সেই সাথে মাটি ও পানির ভিন্নতা অনুযায়ী উদ্ভিদ ও ফসলের যে ভিন্নতা তৈরি হয় ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি কিভাবে এসব সম্পদগুলো এলাকার মানুষকে ঝুঁকিহীন সমৃদ্ধময় জীবনযাপনে সহযোগিতা করে সেই তথ্যটি তরুণ প্রজন্মের মাঝে সম্প্রসারণের চেষ্টা করেছেন। সেই সাথে অনুষ্ঠান স্থলের একটি গাছে এলাকার পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি শিক্ষার্থীর স্বপ্নের কথা লিখতে বলা হয়।
স্বপ্ন গাছের স্বপ্ন বার্তার ভেতর দিয়ে পরিবেশ উন্নয়নে তরুণ প্রজন্মের নিজেদের চিন্তা চেতনা ও আকাংঙ্খা উঠে আসে। তারা তাদের স্বপ্ন প্রকাশের মাধ্যমে সরকার, উন্নয়ন সংগঠন ও নীতিনির্ধারকদের জানিয়ে দেন এই এলাকার তরুণ প্রজন্ম প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশকে সমুন্নত রেখে কি ধরনের উন্নয়ন পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলে নেত্রকোনা এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধকরণে তরুণ প্রজন্মের এই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ
রাজুর বাজার কলেজিয়েট স্কুল এ্যান্ড কলেজের সভাপতি তফশির উদ্দীন খান’র সভাপতিত্বে নেত্রকোনা আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াড ২০১৮ এর বিজয়ী শিক্ষার্থীদের পুরস্কার বিতরণ ও সমাপণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নেত্রকোনা শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক রফিক উল্লাহ্ খান, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নেত্রকোনা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মীর্জা শাকিলা দিল হাছিন, নেত্রকোনা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফখরুজ্জামান জুয়েল। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের গান, কবিতা ও উপস্থিত বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হওয়া সমাপনী অনুষ্ঠানের শুভেচ্ছা বক্তব্যে বারসিক নেত্রকোনা বিসোর্স সেন্টারের এলাকার সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান সংক্ষিতপ্তভাবে আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াড ২০১৮’র আয়োজন ও বারসিকের কর্মপ্রক্রিয়া তুলে ধরেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তার আলোচনায় এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি এ ধরনের আয়োজনে জেলা প্রশাসনের আগ্রহ ও সম্পৃক্ততার বিষয়টি তুলে ধরেন।
নেত্রকোনা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তার আলোচনায় চলমান জলবায়ু পরিবর্তনে গাছের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করে আয়োজিত ট্রি অলিম্পিয়াডের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি প্রতিটি জেলায় এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের ভেতর দিয়ে নতুন প্রজন্মকে পরিবেশ রক্ষায় আরো বেশি সম্পৃক্ত করার উপর জোর দেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান বলেন, ‘এটি একটি ইনোভেটিব আইডিয়া, আমরা গণিত অলিম্পিয়াড, ভাষা অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড দেখেছি, এই প্রথম দেখলাম ট্রি অলিম্পিয়াড, যার প্রধান অতিথি আমি নিজে। এটি আমার জীবনে একটি স্মরণীয় ঘটনা”। এই এলাকায় শিক্ষার্থীরা এধরনের উদ্যোগ আরো গ্রহণ করবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যের শেষে নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজের আহবায়ক এ্যাড. তপতী শর্মা বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন। অতিথিরা বিজয়ী শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার হিসেবে বই ও ক্রেষ্ট তুলে দেন। এছাড়া আঞ্চলিক পর্যায়ে অংশগ্রহণকারী প্রতিজন শিক্ষার্থীকে আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের জন্য সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে ও নেত্রকোনা এলাকায় আরো বেশি বেশি এই ধরনের কর্মসূচি আয়োজনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন সমাপনী সভার সভাপতি তফসির উদ্দীন খান। সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনের দায়িত্ব পালন করেন- নবগঠিত নেত্রকোনা ডিবেট এ্যসোসিয়েশনের সভাপতি ও নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজের সদস্য ফরিদুর রেজা খান।
বিজয়ী শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা
গাছ সম্পর্কিত ৫০টি প্রশ্নের মধ্যে ৩৯টি সঠিক উত্তর দিয়ে নেত্রকোনা আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াডের চ্যাম্পিয়ান অব দ্যা চ্যাম্পিয়ান হয়েছে বিরামপুর গ্রামের হাজী ফয়েদ উদ্দীন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আনিকা আক্তার। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন স্কুলের যে ৫ জন শিক্ষার্থী চ্যাম্পিয়ান হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে- মুনসুরপুর আব্দুল হামিদ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তোফাজ্জল হোসেন, বড়দল উচ্চ বিদ্যালয়ের তানভীর আহম্মেদ, আন্জুমান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নাসিব কবির সরকার, দূর্গাশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ের মেহেদী কবির মিশু ও নলেজ একাডেমির এমদাদুল ইসলাম মুন্না। উল্লেখ্য, যে পাঁচজন শিক্ষার্থী চ্যাম্পিয়ান হয়েছে তাদের মধ্যে নাসিব কবির সরকার ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। অপরদিকে প্রথম রানারআপ হিসেবে যারা বিজয়ী হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে- দূর্গাশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান মারুফ, হাজী ফয়েজ উদ্দীন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের রোমান মিয়া প্রান্ত, নলেজ একাডেমির আব্দুল্লাহ আল নোমান, কোনাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নাজমা আক্তার ও বড়দল উচ্চ বিদ্যালয়ের সুমন মিয়া।
দ্বিতীয় রানারআপ হিসেবে যারা বিজয়ী হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে- কলমাকান্দা সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আছিবুর রহমান সাকিব, লক্ষীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়েমা রহমান স্মৃতি, তেলিগাতী বোদ্যনাথ হরে কৃষ্ণ (বিএনএইচকে) একাডেমির শিক্ষার্থী জুনায়েদ হাসান, মঙ্গলসিদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিগ্ধা ভট্টাচার্য ও লেংগুরা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজেদা খাতুন। পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে বিজয়ী শিক্ষার্থী ছাড়াও দুইজনকে নেত্রকোনা এলাকার পরিবেশবন্ধু ও কৃতি সন্তানকে সম্মননা প্রদান করা হয়। এই বছর জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফলজ ও ঔষধি গাছের চারা বিতরণের জন্য রামপুর এলাকার জনাব আব্দুল হামিদ কবিরাজকে এবং বিশ কিলোমিটার তালগাছের বীজ রোপণের জন্য রফিকুল ইসলামকে আয়োজিত আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াডের অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মননা প্রদান করা হয়। সেই সাথে পরিবেশ রক্ষায় নেত্রকোনার এ দুইজন কৃতি সন্তানের জীবনদর্শন ও পরিবেশ উন্নয়নে অবদানের বিষয়টি শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা হয়।
সাফল্যের কারণ
বিজয়ী শিক্ষার্থীরা তাদের সাফল্যের কারণ হিসেবে বলতে গিয়ে আঞ্চলিক ট্রি অলিম্পিয়াড়ের চ্যাম্পিয়ান অব দ্যা চ্যাম্পিয়ান হাজী ফয়েদ উদ্দীন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনিকা আক্তার বলেন, ‘বৃক্ষ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের স্কুলে আলোচনা হয়। আমাদের প্রধান শিক্ষক স্কুলের শিক্ষার্থীদের দেশীয় ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষ রোপণের জন্য নানাভাবে উৎসাহিত করেন। বারসিকের সহযোগিতায় আমরা আমাদের স্কুলে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী করেছি। আমরা স্কুলের সকল শিক্ষার্থী মিলে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে স্কুলে আসার রাস্তাগুলোতে বৃক্ষরোপণ করেছি। এসব কারণে আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীরা বৃক্ষ বিষয়ে জানার চেষ্টা করে।’ মঙ্গলসিদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিগ্ধা ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের গ্রামে কদমতুলি যুব সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম পরিচালনা করে যেখানে আমরা স্কুলের শিক্ষার্থীরা জড়িত থাকি।
যুব সংগঠনের উদ্যোগে আমরা সকলে মিলে আমাদের গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে দুটি করে দেশীয় ফলের গাছ রোপণ করি। এসব কারণে গাছের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। গাছ নিয়ে কোন কিছু লেখা হলে আমি সেটা পড়ার চেষ্টা করি।’ বিজয়ী শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলতে গিয়ে নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজের সদস্যরা বলেন, ‘বারসিক ও নেত্রকোনা সম্মিলিত যুব সমাজ দীর্ঘদিন ধরে নেত্রকোনা এলাকার পরিবেশ বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কাজ করছে। এসব কর্মসূচিগুলোতে যেসব স্কুল সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত ছিল সেসব স্কুলগুলোই মূলত এখানে ভালো করেছে। এছাড়া এবারের ট্রি অলিম্পিয়াডের পরীক্ষাগুলোকে স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের সুযোগ ছিলো। ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সকল শ্রেণী থেকেই শিক্ষার্থীরা বিজয়ী হয়েছে।’ তারা আরও বলেন, ‘আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমরা মনে করি স্কুলে যারা প্রথম দ্বিতীয় হয় তারাই হয়তো সব বিষয়ে ভালো জানে কিন্তু ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে প্রচলিতভাবে কম মেধাবী (যাদের রোল নম্বর পিছনে) শিক্ষার্থীরাও এখানে খুব ভালো করেছে। তাই সার্বিকভাবে বলা হয় এই আয়োজনটি স্কুলের সকল শিক্ষার্থীকে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হতে ভূমিকা রেখেছে। প্রচলিতভাবে কম মেধাবী শিক্ষার্থীরাও তাদের জানাশোনা পরিসর ও দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছে। এটিই ছিল এই আয়োজনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।’