স্বপ্নজয়ী মানুষ হযরত আলী
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
নিজের জীবনে সকল স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে না পারলেও মানুষের মাঝে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়ে নিজের জীবনের সকল স্বপ্ন অন্যের মাঝে খুঁজে অনেক মানুষ। তাদের নিজেদের স্বপ্ন পূরণ না হলেও অন্যের মাঝে সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দেখে আত্মতৃপ্তি পান। নিঃস্বার্থভাবে তারা কাজ করে যান অন্যের জয় বা সফলতা আনার জন্য। তাদেরকে আমরা পরোপকারী মানুষ বলি। এরকমই একজন পরোপকারী মানুষ হচ্ছেন নেত্রকোনা জেলা আমতলা ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের মো. হযরত আলী। হযরত আলী কেন পরোপকারী একজন মানুষ তা নিম্নের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হবে।
একজন আদর্শ শিক্ষক
আদর্শ শিক্ষক হবার স্বপ্ন নিয়ে বড় হলেও এসএসসি পাশ করার পরই আর্থিক সংকটের কারণে হযরত আলীর পড়া বন্ধ হয়। তাকে পরিবারের হাল ধরতে হলো। পারিবারিক কৃষি কাজের পাশাপাশি তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করে এলাকার শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন খুব কম বয়স থেকে। প্রাইভেট পড়ানোর পথ ধরে নিজের স্বপ্ন পূরণে যাত্রা শুরু করেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট না থাকায় কোন সরকারি স্কুলের শিক্ষক না হয়েও তিনি শিক্ষক হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। নিজের যেটুকু মেধা আছে তা নিয়ে নিজ এলাকার শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো জ্বালাতে তৈরি করেছেন প্রতিশ্রুতি কিন্ডাগার্টেন স্কুল যেখানে থেকে প্রতিবছর শত শত শিক্ষার্থীদের ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি মাতৃভূমি বাংলার মাটি, ফুল, পাখি, গাছপালাকে ভালোবেসে বড় হওয়ার মানুষিকতা তৈরির উপর গুরুত¦ দিয়ে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয় বলে তিনি জানান।
তরুণদের উৎসাহদাতা
হযরত আলী পাঁচকাহনীয় গ্রামের চারপাশে গাছগড়িয়া, বিশ্বনাথপুর, দেওপুর, কাঁটাখালি রামকৃষ্ণপুর গ্রামের যুবদের কাছে একজন স্বপ্ন জয়ী মানুষ। কিন্ডার গার্ডেনের পাশাপাশি গ্রামের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি তৈরি করেছেন কোচিং সেন্টার যেখানে এলাকার পিছিয়ে পড়া এবং শিক্ষা গ্রহণে অনাগ্রহী শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান করেন, সচেতন করতে তাদের সামনে তুলে ধরেন বিভিন্ন গুণী ব্যক্তিদের জীবনচিত্র, যারা শিক্ষা ও ভালো কাজের মাধ্যমে পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন। তার এ সকল ভিন্নধর্মী শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখায় ভালো কিছু করার। তিনি যুবদের মোবাইল আসক্তি, বাজে আড্ডা না থেকে পরিবেশবান্ধব কাজে মনোনিবেশ করতে উৎসাহ দেন। এজন্য তিনি প্রতিবছর আয়োজন করেন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ তৈরিতেও তিনি সমানতালে কাজ করেন। তাই তো ধনী, দরিদ্র, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই প্রতিবছর তার উদ্যোগে আয়োজিত স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অংশগ্রহণ করে।
সংস্কৃতিমনা
হযরত আলী একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ। এলাকার সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে তিনি জড়িত। এছাড়া কৃষক, শ্রমিক এবং সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। বৈচিত্র্যের প্রতিও শ্রদ্ধা করেন এবং তিনি বিশ্বাস করেন একটি বহুত্ববাদী সমাজ বিনির্মাণ খুবই জরুরি। তিনি বারসিক’র বিভিন্ন কর্মসূচিতেও যুক্ত থাকেন। এভাবেই তিনি যুব, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে তৈরি করেছেন শিক্ষা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি।
পরিবেশকর্মী
হযরত আলী পরিবেশ বিপর্যয়রোধ নানানভাবে স্ব অবস্থান থেকে তৎপর থাকেন। সবুজমনা এই ব্যক্তি পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং আর্থিক খরচ কমানো লক্ষ্যে গত ৮ বছর আগে নিজ বাড়িতে বায়ু গ্যাস তৈরি করেন। বায়ু গ্যাস প্রস্তুত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বায়ু গ্যাস তৈরি জন্য সবচেয়ে বড় উপাদান বাড়িতে গরু পালন, যা স্থায়ীভাবে নিজের পরিবারের একজন সদস্যের মতো সারাবছর লালন পালন করতে হবে। ৭ থেকে ৮ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের দৈনিক ৩ বেলা রান্নার জন্য ৫ থেকে ৬টি গরু পালন করতে হয়। হযরত আলীর এই কাজে তার স্ত্রীর রয়েছে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা। মূলত স্ত্রীর উৎসাহে নিজ বাড়িতে বায়ু গ্যাস তৈরি করেন। যার মাধ্যমে নিজের পরিবারের জ্বালানি সংকট মোকাবেলার পাশাপাশি বাড়ির চার পাশের পরিবেশকে কার্বনমুক্ত রাখতে পেরেছেন দীর্ঘ দিন ধরে। সেই সাথে বায়ু গ্যাস থেকে ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টাংশ জৈব সার হিসেবে জমিতে ব্যবহার এবং পুকুরে স্থানীয় জাতের মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করেন।
একজন স্বপ্নজয়ী মানুষ হযরত আলী নিজের স্বপ্নকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে নিজ এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের যুব কিশোরদের মাঝে আদর্শ মানুষ তৈরির যাত্রা শুরু করেছেন। সেই পথ ধরে অনেক যুব আমাদের সমাজ, দেশ পরিবর্তনের পথে হেটে যাবে যা একটি সুন্দর বহুত্ববাদী সমাজ বিনির্মাণে সূচনা করবে বলে তিনি মনে করেন।