আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও একজন সুজাতার গল্প

সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শিমুল বিশ্বাস

‘সমাজে একজন মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে সকল প্রশংসার দাবিদার আমার মা। আমার জীবনের আইডল তিনি। আমি যখন অনেক ছোট, তখন মা’কে দেখেছি নিজে হোন্ডা চালিয়ে অফিস করতে। তখন থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল, আমি মায়ের মত হবো।’ সম্প্রতি গোলাই কালিগঙ্গা কৃষক কৃষাণি সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একথাগুলো বললেন অগ্রগামী নারী সুজাতা। ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বারসিক’র সহযোগিতায় গোলাই কালিগঙ্গা কৃষক কৃষাণি সংগঠন আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আয়োজন করে।’


উক্ত অনুষ্ঠানে ‘আসুন নারীর গল্প শুনি’ আলোচনায় জীবনে নারী থেকে একজন মানুষ হিসাবে বেড়ে ওঠার গল্প উপস্থাপন করেন ২৩ বছর বয়সী তরুণী সুজাতা। সুজাতা ছাড়াও নারী দিবসের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সংগঠনের সভাপতি সেলিনা বেগম, সহসভাপতি মনোয়ারা বেগম, ভানু বিবি, বারসিক কর্মকর্তা বিউটি সরকার, শারমিন আক্তার প্রমুখ।


নারী দিবসের আলোচনায় মূখ্য ভুমিকা পালন করেছেন সিংগাইর উপজেলার উত্তর জামসা নয়াপাড়া গ্রামের সুজাতা। মূলত সুজাতার গল্প দিয়েই এবারের নারী দিবসের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। আলোচনায় সুজাতা নিজের জীবনের গল্প দিয়ে সমাজে নারী মুক্তি এবং নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
গল্পটি এমন ছিল-ছোট বেলা থেকেই মা’কে অনুসরণ করে বড় হয়েছেন সুজাতা। ছেলে হারানো মাকে শান্তনা দেওয়ার জন্য পোশাক পড়েছেন ছেলেদের মত। তিনি পাড়া প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবের সাথে মিশেছেন স্বাভাবিক ভাবে। আর এভাবেই নারী থেকে মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার যাত্রা শুরু তার। আজ সুজাতা সমাজে একজন মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। সামাজিক বিধি নিষেধ তাকে পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ করতে পারেনি। চলাফেরা করেন নিজস্ব যানবাহনে (হোন্ডা )।

সম্প্রতি তিনি এ যানবাহন চালিয়ে ১৫দিনে ঘুরেছেন দেশের ৬৪টি জেলা। হোন্ডা চালনার অভিজ্ঞতা আছে বলেই মা আকলিমা আক্তার মমতাজ (শান্তি) কে সহজেই পৌছে দিতে পারেন সিংগাইর উপজেলস্থ কর্মস্থলে। নারী হলেও দিন এবং রাতেও অবাধে চলাফেরা করার মানসিকতা ও সাহসিকতা রাখেন সুজাতা। যে কারণে দুদিন আগেও রাতে বেলায় সিংগাইর এলাকার বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘুরে উদ্ধার করেছেন নিজের চুরি যাওয়া গরু। তিনি বলেন, ‘আমার সংসারের প্রয়োজনীয় কোন কাজের জন্য কারো কাছে যাই না, বরং প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন সাহায্য নিতে আসে আমার কাছে।’ জীবনে মাটি কাটা থেকে শুরু করে ধান রোপণ, ধান কাটা সবই করেছেন তিনি সংসারের প্রয়োজনে। ২০১৫ সালে মাধ্যমিক পাশ করার পর বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন সুজাতা। বাঁধাধরা জীবন ভালো না লাগায় ১ বছর পর ছেড়ে আবার লেখাপড়ায় মনোযোগি হন এ নারী। বর্তমানে তিনি আইন বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করছেন। তিনি একজন ভালো নৃত্যশিল্পীও বটে। নৃত্য, থিয়েটার, নাটক, শর্টফিল্ম, বাইকিং, সাইকিলিং করা তাঁর নেশা ও পেশা। প্রাণীদের প্রতি রয়েছে তার অন্যরকম মমতা। নিজের ৪টি রেড়াল, ৪টি কুকুর প্রতিপালন করেন তিনি। আর নারী হিসাবে এসব কাজ করার ক্ষেত্রে মানসিকতা ও দক্ষতা উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এ অগ্রগামী নারী।


পরিশেষে সকলের উদ্দেশ্য সুজাতা বলেন, ‘আমাদের সমাজে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে তাদের জীবনকে অন্ধকারে ঢেকে দেয়া হয়। বঞ্চিত করা হয় নারীদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ থেকে। সমাজ ও লোক লজ্ঝার ভয়ে নারী বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই পাছে লোকে কিছু বলে এসব উপক্ষো করে সকল নারীদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই হবে নারী মুক্তি এবং নারীর ক্ষমতায়ন। একজন নারী সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে একজন মানুষ হিসাবে। যা প্রকৃত উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”

happy wheels 2

Comments