সাম্প্রতিক পোস্ট

শিল পাটা ধার করাইবেন গো… শিল পাটা

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

রান্নার গুণে খাবারের স্বাদ অনেকখানি বেড়ে যায়। আর সেই খাবার তৈরি করতে লাগে নানান উপকরণ। তার মধ্যে মসলা একটি অন্যতম উপাদান। হলুদ, মরিচ, জিরা, ধনিয়া আরো কত পদ আছে মসলার। তবে রান্নার সময় এগুলো আস্ত দেওয়া যায়না। গুঁড়ো করে বা পিষে তারপর তরকারিতে দিতে হয়। মসলা বাটার জন্য যে জিনিসটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে পাটা আর শিল। শিলপাটা হচ্ছে দুই খণ্ডের পাথর যা রান্নাঘরে মসলা পেষার জন্য ব্যবহার করা হয়। পাটা হচ্ছে চার কোণাকৃতি আর শিল একটু গোলাকার, লম্বাটে।

IMG_20191113_140955_6
গ্রামে কিংবা শহরে ঈদ, বিয়ে, বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে শিল পাটা একটি প্রয়োজনীয় উপকরণ। মসলা পিষা ছাড়াও ঈদের সময় মেহেদী, বিয়েতে কাঁচা হলুদ ইত্যাদি পিষে নিতে শিল পাটা চাই-ই চাই। এ সমস্ত অনুষ্ঠানের আগেই বাড়ির নারীরা এগুলো ধার করিয়ে রাখতেন।

দীর্ঘদিন মসলাসহ ইত্যাদি উপকরণ বাটার জন্য ব্যবহৃত শিল পাটা ক্ষয় হয়ে যায়। ফলে এগুলোকে আবার ধার করাতে হয়। আর এই শিল পাটা ধার করানোর জন্য কিছু নির্দিষ্ট লোক আছে। তারা শিল পাটা ধার করাইবেন গো… শিল পাটা, এই বলে বলে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। কাঁধে থাকে একটি টিনের বাক্স বা চটের ব্যাগ। এই ব্যাগের ভিতর থাকে চশমা, হাতুড়ি, লোহার তৈরি এক ধরণের বিশেষ লম্বা যন্ত্র। যা পাটার উপর রেখে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করার ফলে পাথরের উপর ছোট ছোট ছিদ্র হয়। এভাবেই ধার করা হয়ে গেলে পুনরায় মসলা বাটার উপযুক্ত হয়। আর চশমা না পড়ে পাটা কাটলে পাথরের গুঁড়া চোখ যেতে পারে। তখন চোখের ক্ষতি হয়।

কিন্তু বর্তমানে আধুনিক ব্লেন্ডার মেশিন ও প্যাকেটজাত গুঁড়া মসলার প্রভাবে এই শিল পাটার ব্যবহার অনেটাই কমে গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে এই পেশাধারীদের পেশা। নেত্রকোনা শহরের মালনী এলাকার রঞ্জন মন্ডল এই শিল পাটা কাটানোর কাজ করেন। তিনি প্রায় দশ বছর যাবৎ এই পেশার সাথে যুক্ত। আগে টিন কেটে কুপি বানানোর কাজ করতেন। কিন্তু বর্তমানে প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকার কারণে কেউ এখন আর কুপি বাতি ব্যবহার করেনা। যে কারণে তিনি এই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।

এখন একটি ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নেত্রকোনা শহরের বিভিন্ন জায়গায় বাসা বাড়িতে ডেকে ডেকে যায়। প্রতিদিন তিনি প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। প্রতিটি শিল পাটা ধার করতে তিনি ১০০ টাকা থেকে ১২০টাকা করে নিয়ে থাকেন। কিন্তু এই দামও অনেকে দিতে চায়না। সারাদিন ঘুরে ৩/৪টি পাটা ধার করতে পারেন। কারণ এখন বেশিরভাগ মানুষই প্যাকেটের মসলা ব্যবহার করে রান্না করেন। আবার কেউ বেশি পরিমাণে মসলা কিনে মেশিন দিয়ে গুঁড়া করে নিয়ে আসেন।

শহরে রোজগার কম বলে রঞ্জন মন্ডল চলে যান শহরের আশেপাশের গ্রামে। বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ, আমতলা, দেওপুর, চল্লিশা এ সমস্ত জায়গায় ঘুরে বেড়ান। শহরের তুলনায় গ্রামের লোকজন পয়সা কম দেয়। তবুও সেখানে কাজ পাওয়া যায় বেশি। কারণ গ্রামের অনেকেই এখনো পাটায় বেটে মসলা দিয়ে তরকারি রান্না করেন। সারাদিন ঘুরে তিনি যা রোজগার করেন তা দিয়ে ৪ জনের সংসার চলেনা। তাছাড়া মেয়েটিকে লেখাপড়া করাচ্ছেন শহরের একটি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেখানেও প্রচুর খরচ। ছেলেটি নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন কোনো কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। যদি বাবাকে সাহায্য করা যায়।

রঞ্জন মÐল পাটা ধার করাতে অনেক নামী দামী মানুষের বাড়িতে গিয়েছেন। সেখানেও তিনি বলে এসেছেন ছেলের চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। অনেকেই আশ্বাস দিয়েছেন। বাকিটুকু ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছেন। আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আইজ যদি আমি লেখাপড়া জানতাম তাইলে মাইনষের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হইতোনা। চাকরী করতাম বা ভালো কোনো কাজ করতাম। মেয়েডারে পড়াইতাছি। বড় চাকরী না করতে পারুক, দুইডা টিউশনি কইরাওতো চলতে পারবো।’

সকালে কোনো দিন একমুঠো খেয়ে বা না খেয়ে ঘুরে বেড়ান তিনি। বাড়ির দরজায় গিয়ে যখন ডাকেন শিল পাটা ধার করাইবেন গো… শিল পাটা, তখন যাদের প্রয়োজন তারা ছুটে আসেন। আর ডেকে নিয়ে যায় বাড়ির ভিতরে। একটি শিল আর একটি পাটা ধার করতে তার ২০/২৫ মিনিট সময় লাগে। অনেকে তার সাথে বসে গল্প করেন আবার কেউ খাবারও খেতে দেন। কাজ শেষ করে আবার বেড়িয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় বা রাতে বাড়ি ফিরে আসেন। পরের দিন শুরু হবে আবার ব্যস্ততা। এভাবেই কেটে যায় রঞ্জন মন্ডলের মতো অনেকের জীবন। তাঁদের ভবিষ্যত বলে কিছু নেই। বর্তমানের চিন্তায় অস্থির থাকতে হয় সারাক্ষণ।

আধুনিক পৃথিবীতে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর অভ্যাস। যে অভ্যাসের বেশিভাগ দিকই ছিল ইতিবাচক। মানুষ একটা নিয়মের মধ্যে, আচারের মধ্যে চলতো। এখন আর সেটি তেমনভাবে চোখে পড়েনা। নির্দিষ্ট কিছু প্যাকেট আর ব্যান্ডের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে সব। রাঁধুনি বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠতো ঘোমটা পড়া বৌ। এখন রাধুঁনি থাকে প্যাকেটের গায়ে। কত সহজ হয়েছে কাজ। এই সহজের ভিড়ে আমরাই না কবে বিলীন হয়ে যাই।

happy wheels 2

Comments