গাসন্ত চিকিৎসার অন্যতম উদ্ভিদ নাগদানি
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
গাসন্ত চিকিৎসকদের (গাছের বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে যারা ঔষধ তৈরি করেন) চিকিৎসার প্রধান উপাদান হলো গাছপালা ও প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো উদ্ভিদ। গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র বিচ্ছিন্নভাবে এই ধরনের চিকিৎসকের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত নয়। তারা গ্রামের জনগোষ্ঠীর কাছে কৃষক বলেই পরিচিত। তবে তাদের গাসন্ত জ্ঞান দ্বারা অনেককেই চিকিৎসা করেন বিনামূল্যে। তাদের এই জ্ঞানকে শুধুমাত্র নিজেদের ও প্রতিবেশীদের প্রয়োজনে প্রয়োগ করেন এবং নিজেদের প্রয়োজনীয় উদ্ভিদগুলো নিজেরাই সংরক্ষণ করেন। গ্রামাঞ্চলের গাসন্ত চিকিৎসকদের সংরক্ষণে থাকা উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম একটি উদ্ভিদ হচ্ছে নাগদানি। প্রায় ২৩টি রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই উদ্ভিদটি নিয়ে নিন্মের লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।
নাগদানি দেখতে অনেকটাই চন্দ্রমল্লিকা ফুলের মত। আপাত দৃষ্টিতে এই দু’টোকে প্রায় একই প্রজাতির মনে হবে। নাগদানি সম্পর্কে যাদের ধারণা কম তারা একপলক দেখেই একে চন্দ্রমল্লিকা ফুল বলে ভুল করবেন। এর পাতার ধরন, পাতার ঘ্রাণ প্রায় একই রকম। তবে নাগদানি ও চন্দ্রমল্লিকা ফুলের পাতার ঘ্রাণের মধ্যে খুবই সুক্ষ্ম কিছু পার্থক্য আছে। গাছের উচ্চতা চন্দ্রমল্লিকা গাছের তুলনায় একটু বেশি। এই সম্পর্কে কবিরাজ ঘৃটেন চিসিম বলেন, ‘এর ফুলের রঙ হালকা হলুদ’। নাগদানি দুই ধরনের হয়ে থাকে। বড় জাতের পাতা ও ফুল আকারে বড় হয়। আর ছোট জাতের পাতা ও ফুল আকারে ছোট হয়ে থাকে। বড় জাতেরগুলো ঔষধি হিসেবে বেশি কার্যকর। ফুল কোন কাজে ব্যবহার না হলেও গাসন্তীরা এর পাতা ও শেকড় ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যবহার করে থাকেন। রোগের ধরন অনুসারে নাগদানির সাথে অন্যান্য উদ্ভিদও ব্যবহার করেন। তবে ২২টি রোগের জন্য নাগদানি অবশ্যই প্রয়োজন।
কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের বেতুয়া গ্রামের মস্ত মিয়া (৭০) একজন কৃষক ও গাসান্তী কবিরাজ। তিনি শুধুমাত্র নিজস্ব প্রয়োজনে এবং কেউ তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্য আসলে বিনামূল্যে বাড়ির আশেপাশে জন্মানো ও নিজের সংরক্ষিত উদ্ভিদের লতাপাতা দিয়ে ঔষধ তৈরি করে দেন। তিনি বলেন “আমি নাগদানি দিয়া হাপানী, নিমুনিয়া, যক্ষ্মা, সুতিকার, বীষব্যাথা, গ্যাস্টিক, কইলজা কামড়, ধাতু দূর্বলতা, গনোরিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ চিকিৎসা করি। নাগদানির লগে আরো কিছু দিই কিন্তু নাগদানি লাগবই। অনেকে আমার দেয়া ঔষধ খেয়ে সুফল পেয়েছেন।” কেউ যদি তার কাছে শিখতে চাই তাহলে তিনি তা শিখাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে নাগদানির কিছু কিছু ব্যবহার তার স্ত্রী জানেন বলে তিনি জানান।
রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের কবিরাজ ঘৃটেন চিসিম (৭৬)। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে ঔষধি গাছ সংগ্রহ করতে করতেই বাবার কাছ থেকেই রপ্ত করেছেন গাছপালা দিয়ে চিকিৎসা পদ্ধতি। তার মাধ্যমে এ পর্যন্ত অনেক রোগী সুস্থ হয়েছেন। রোগীদের চিকিৎসার জন্য এবং কাশি, শিশুদের সাধারণ জ্বর ও হাত পা কেটে গেলে রক্ত পড়া বন্ধ করার জন্য নাগদানি ব্যবহার করেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা কবিরাজি করে তাদের জন্য নাগদানি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গাছ। একসময় প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এটি দেখা যেতো। এখন মানুষ এর গুরুত্ব না বুঝে এটি যতœ না করায় এই গাছগুলো মরে গেছে। তাই এই গাছটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আগে পাহাড়ে গেলেই পাওয়া যেতো, এখন পাহাড়েও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই কারণে আমি বাড়িতেই দরকারি গাছগুলো লাগিয়ে রাখি।” তিনি এমন কতিপয় মানুষকেই তার এই কবিরাজি জ্ঞান দান করতে চান, যারা সত্যিকার অর্থেই মানুষের মঙ্গলের জন্য তার রেখে যাওয়া জ্ঞানকে ব্যবহার করবেন।
ঘৃটেন চিসিম ও মস্ত মিয়ার মত আরো কিছু কৃষক পাওয়া যায় এলাকায় যারা নিজেদের ও পাড়া প্রতিবেশীর প্রয়োজনে গাছগাছান্তি কবিরাজি করেন। তাদের মধ্যে রংছাতি ইউনিয়নের পাতলাবন গ্রামের সুকাশ চাম্বুগং (৪০) ও নাজিরপুর ইউনিয়নের আরতী ঘাগ্রা (৪২) অন্যতম। সুকাশ চাম্বুগং ও আরতী ঘাঘ্রা নাগদানির ব্যবহার শিখেছেন তাদের মায়েদের কাছ থেকে। তারা নাগদানি ব্যবহার করেন বাত জ্বর এবং এলার্জিজনিত চিকিৎসার জন্য। তাদের প্রত্যেকেরই অভিমত মানুষ যদি গাছপালার ঔষধি গুণ জানেন তাহলে তাদের মত করে প্রত্যেক মানুষই ঔষধি গাছপালা সংরক্ষণ করবেন। আর ডাক্তারের কাছে ঘন ঘন যাওয়া কমবে এবং অনেক খরচও কমবে।
ঘৃটেন চিসিম, মস্ত মিয়া, সুকাশ চাম্বুগং এবং আরতী ঘাঘ্রারা মনে করেন, তাঁদের এই জ্ঞান যদি বর্তমান প্রজন্ম গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে অনেক মূল্যবান ঔষধি গাছ ও গুল্ম প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাঁরা মনে করেন, দুই প্রজন্মের মধ্যে জ্ঞানের সমন্বয় ঘটলেই কেবলমাত্র সমৃদ্ধ থাকবে প্রকৃতি ও পরিবেশ।