সম্মিলিত উদ্যোগই পারে ‘করোনা’ প্রতিহত করতে
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
গ্রাম বাংলাংয় একটা খেলার প্রচলন ছিলÑ‘বরফ পানি’। যেখানে একদল শিশুরা গোল হয়ে দাঁড়াতো, একজন নির্দেশ দিতো। বরফ শব্দটি বললে যে যার অবস্থানে থেকে থেমে যেতো। আবার পানি বললে নড়াচড়া করতে পারতো। করোনার দাপটে আমরা এখন সবাই বরফের অবস্থায় আছি। নড়াচড়া নেই, নেই কোনো কর্মকাজ। সবাই নিজেকে রক্ষা করতে ব্যস্ত। কবে যে পানি হবো এখনো অজানা।
‘করোনা’ পৃথিবী থমকে গেছে একটি মাত্র শব্দে। মানুষ থেকে মানুষে, দেশ থেকে দেশান্তর দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে এই অদৃশ্য শত্রু। এটি এমন একটি রোগ এখন পর্যন্ত যার কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। দৃশ্যমান শত্রুকে পরাজিত করা যায় কিন্তু অদৃশ্য শত্রু শুধু ধ্বংসই করে। আমরা এখন সকলে মিলে এই অদৃশ্য শত্রুর মোকাবেলা করছি। সকল শ্রেণি, পেশা, ধর্ম ও বয়সের মানুষ একটি নামের ভয়াবহতায় আতঙ্কিত।
এ যাবৎ পর্যন্ত যতটুকু জানা ও বোঝা গেছে তার মূল কথা হলো সচেতনতা। শুধু সচেতনতাই পারে এ রোগ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে। সারা বিশ্বের প্রচার মাধ্যম এর ভয়াবহতা রুখতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে সমস্ত এলাকায় মিডিয়া এখনো তেমন ভাবে সম্প্রসারিত হয়নি, সেখানে এই কাজটিতে এগিয়ে এসেছে একদল যুবক। তারা নিজ গ্রামের মানুষকে সচেতন করতে সময়োপযোগি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এবং সেই মোতাবেক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
শুরুটা হয়েছিল মার্চ মাসের শেষ দিকে। অর্থাৎ যখন সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এর আগেই অবশ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষার্থীরা সবাই নিজ বাড়িতে। যারা গ্রামের বাইরে ছিল তারাও বাড়ি ফিরে এসেছে। লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের আতকাপাড়া গ্রামের শিক্ষার্থী আয়াতুল ইসলাম গ্রামের সতীর্থদের নিয়ে একটি দল গঠন করে। উদ্যেশ্য হলো গ্রামের মানুষকে সচেতন করে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করা। ২০জনকে নিয়ে এই উদ্যোগি যুবক পরিকল্পনা করে গ্রামে কি কি কাজ করা যায়। যেই ভাবা, সেই কাজ।
সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আগে নিজেদের সুরক্ষিত করতে হবে। এই কাজের জন্য সকলে মিলে কিছু চাঁদার ব্যবস্থা করে। প্রথমে নিজেদের জন্য মাস্ক ও হ্যা- গ্লাভস কিনে নেয়। পরে জীবাণুনাশক, সাবান, এগুলোও কিনে আনে। গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে স্প্রে মেশিন চেয়ে নেয়। স্প্রে মেশিনের সাহায্যে পুরো গ্রামে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে দেয়। মসজিদের অযুখানা, চা’র স্টল, মুদি দোকানসহ গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাবান রেখে দেয়। এছাড়া নিজেরাই কম্পিউটারের সাহায্যে সচেতনতামূলক উদ্ধৃতি লিখে গ্রামের বিভিন্ন গাছে, বাড়িতে, মসজিদে, দোকানে লাগিয়ে দেয়।
অনেকেই হয়তো পড়তে জানেনা। তাদের জানানোর জন্য গ্রামে মাইকিং করে। ইউপি চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে নিজেদের গ্রামকে লকডাউন ঘোষণা করে। তাছাড়া গ্রামে যাদের বাড়িতে অন্যান্য এলাকার লোকজন আসে তাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে বোঝানোর মাধ্যমে বাড়িতে থাকার অনুরোধ করে। তারা যখন এসব বিধিনিষেধ মানতে অস্বীকৃতি জানায় তখন চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় নির্দিষ্ট বাড়িতে লাল নিশান টানিয়ে ঐ বাড়িটি লক ডাউন করে দেয়।
এখানেই শেষ নয়, গ্রামবাসীদের কোনো সমস্যার সমাধান করতে নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। দায়িত্ব অনুযায়ী দিনের বেলা প্রতি দুই ঘন্টা করে তারা মানুষের বাড়ি বাড়ি যায়। এবং সমস্যা জেনে সমাধান করে দেয়। যেমন কারো বাজার করে দেয়া, কারো বা গরু বেঁধে দেয়। অর্থাৎ যার যে প্রয়োজন সেই অনুযায়ী তারা সাহায্য করেছে। আবার কোনো গ্রামবাসী বা আগত ব্যক্তিরা প্রতিবেশিদের বাড়িতে, বাজারে বা কোথাও ঘোরাঘুরি করলে সেখানেও হাজির হয় তারা। কখনো অনুরোধ বা কখনো শাসনের মাধ্যমে তাদেরকে ঘরে ফিরিয়ে নেয়। এভাবেই বিগত সময় থেকে এখন পর্যন্ত নিজেদের গ্রামের মানুষকে করোনামুক্ত রাখতে পেরেছে।
গ্রামের সকলের অর্থনৈতিক অবস্থা সমান নয়। ইউপি সদস্য’র সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারের তালিকা করতে সহযোগিতা করে। এখানেও থেমে থাকেনি এই ভলান্টিয়ার দল। এই দলের সকলেই শিক্ষার্থী হলেও কয়েকজন পড়ালেখার পাশাপাশি অর্থ উপার্জনের সাথে যুক্ত। যেমন কেউ ছাত্র পড়ায়, কেউ আবার কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করে। আবার কেউ স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খ-কালীন শিক্ষকতা করে। এদের মধ্যে ১৩জন সদস্য তাদের উপার্জনের টাকা দিয়ে গ্রামের ২১টি পরিবারের মধ্যে ত্রাণ সহযোগিতা প্রদান করে। এসবের মধ্যে ছিল মাস্ক, ৫কেজি চাল, ১ কেজি আলু, ১কেজি মসুর ডাল ও ১লিটার তেল।
এই কাজ করতে গিয়ে অনেকের কাছ থেকে কটু কথাও শুনতে হয়েছে। শিক্ষিত বলে অবজ্ঞাও করেছে। অনেকে বলেছে পড়ালেখা শিখে দেশ উদ্ধার করতে এসেছে। আবার অনেকে তাদের বাড়িতেও ঢুকতে দেয়নি। নানান জনের নানান কথা শুনেও তারা থেমে থাকেনি। এখনো তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের বিভিন্ন প্রবেশ পথে বাঁশ বেধে রেখেছে। কোনো আগন্তুক বা ভিক্ষুককে গ্রামে প্রবেশ করতে দিচ্ছেনা। প্রবেশ পথেও পাহারার ব্যবস্থা রেখেছে।
গ্রামের একদল উদ্যোগি যুবকের কর্মকান্ডে অনেকে বাধা দিলেও কেউ কেউ আবার তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছে। যাতে তারা থেমে না যায়। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সহযোগিতায় এখনো এই গ্রামের সকলেই সুস্থ্য আছেন। অনেক দরিদ্র পরিবার উপকৃত হয়েছে। মানুষের প্রয়োজনেই মানুষ। দেশের এই দুর্যোগ মুহূূর্তে যুবকদের এ ধরণের উদ্যোগ এলাকার বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে।