ভাগ্য উন্নয়নে নাসরিন নাহারের প্রচেষ্টা
শ্যামনগর,সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান
চারধারে লবণ পানি মাঝখানে বসতবাড়ি। লবণ পানি এবং লবণ মাটির সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় উপকূলীয় দ্বীপ অঞ্চল পদ্মপুকুর ইউনিয়ন বাসীর। নদী সংযোগ ইউনিয়ন হওয়াতে এখানে চিংড়ী ঘেরের সংখ্যা অনেক বেশি এবং কৃষি জমির পরিমাণ খুবই কম। আইলার পর অবশিষ্ট কৃষি জমি নোনা পানির চিংড়ী চাষের আওতায় চলে যায়। বর্তমানে বসতভিটা ছাড়া ইউনিয়নের সমস্ত কৃষি জমিতে চিংড়ী চাষ হয়। এই ইউনিয়নের মানুষের কর্মসংস্থানের ভয়াবহ সংকট। ইউনিয়নের প্রায় শতকারা ৮০ ভাগ পরিবারের পুরুষেরা বছরের অধিকাংশ সময় কাজের জন্য বাইরে চলে যায়। ইট ভাটায় শ্রম বিক্রি, শহরে রিক্সা-ভ্যান চালানো, মাটির কাজসহ নানান কাজে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যেতে বাধ্য হয়।
উপকূলীয় অঞ্চল শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামের বাসিন্দা নাসরিন নাহার। ১ ছেলে ও ১ মেয়েসহ মোট ৪ জনের সংসার। ছেলে অষ্টম শেণীতে পড়ছে আর মেয়েটা ২য় শ্রেণীতে পড়ছে। ৮ম শ্রেণী পাশ করার পর মো. জাকির হোসেনের সাথে বিয়ে হয়। তার স্বামী মোটর সাইকেল ভাড়া চালান কিন্তু তাতে তাদের সংসার ভালোভাবে চলে না। প্রথমদিকে তিনি ছোট শিশুদের প্রাইভেট পড়িয়ে সংসারের খরচ চালাতে স্বামীকে সহযোগিতা করতেন। পরবর্তীতে তিনি বসত ভিটায় সবজি চাষ শুরু করেন। নাসরিন নাহার বাপের বাড়ি থাকতে তার মায়ের কাছ থেকে বিভিন্ন শাক সবজি চাষ করার কাজ শিখেছেন। স্বামীর সংসারে এসে অভাবের মুখোমুখি হয়ে নাসরিন মায়ের কাছে থেকে শেখা জ্ঞানকে কাজে লাগাতে শুরু করেন। শুরু করেন নিজ বসতভিটায় বারোমাস সবজি উৎপাদনের কাজ।
নাসরিন নাহার এখন বার মাসই মৌসুমভিত্তিক সবজি চাষ করে চলেছেন। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সবজি বাজারে বিক্রি, আত্মীয় স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের খেতে দেন। সবজি বিক্রির টাকা দিয়ে ছেলের লেখাপড়া খরচ ও সংসারের টুকিটাকি জিনিস (হাঁড়ি, চৌকি খাট, আলনা, শোকেজ) ক্রয় করেন। নাসরিন নাহার বলেন “বর্ষা মৌসুমে আমার বসত ভিটায় লাউ, ওল, কচুরমুখী, ঢেঁড়ষ, বরবটি, তরুল, ঝিঙ্গে, কুশি, মিষ্টি কুমড়া, ডাটাশাক, পুঁইশাক, উচ্ছে, চালকুমড়া এই ১৩ প্রকার সবজি নিয়ে একটি পরীক্ষণ প্লট করেছি।” তিনি আরো বলেন, “সংসারের আয় বৃদ্ধি করার জন্য ৩ মাসের দর্জি কাজের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ছিট কাপড় ক্রয় করতে না পারায় হাতের কাজটি প্রায় ভুলে যেতে বসেছিলাম। এক পর্যায়ে বারসিকের সাথে বিষয়টি সহভাগিতা করা হলে বারসিক আমার জ্ঞান, উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে গতিশীল এবং অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে ছিট কাপড় সহযোগিতা করে। সেই সহযোগিতা থেকে এখন আমি কাপড় তৈরী করছি। স্যালোয়ার কামিজ তৈরীর মজুরি বাবদ ৬০ টাকা এবং ছিট কাপড় বিক্রি করে গজ প্রতি ১৫/১৬ টাকা লাভ হচ্ছে। দর্জি কাজের পাশাপাশি আমি থ্রি পিস ও বিক্রি করছি।”
এছাড়া নাসরিন নাহার নিজের এবং ছেলে মেয়ের কাপড় ও নিজেই তৈরি করছেন। যা থেকে তার খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। দর্জি কাজে সহায়তা ও সবজি চাষের ফলে নাসরিনের কাজ একদিকে যেমন গতিশীল হয়েছে তেমন তার আয়ের উৎসও তৈরি হয়েছে। তাছাড়া তার আয় থেকে তিনি টাকা জমিয়ে নিজেই কালিগঞ্জ এবং সাতক্ষীরা থেকে ছিট কাপড় ক্রয় করছেন।
নাসরিন নাহার জানান, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের প্রতিটি নারীকে ঘরে বসে সময় কাটাতে হয়। চিংড়ী চাষের কারণে এলাকায় গবাদিপশু নেই বললেই চলে। সংসার দেখাশুনার পাশপাশি বসতভিটায় সামান্য সবজি চাষ ও অল্প হাঁস-মুরগি পালন ছাড়া কোন কাজ নেই। বিভিন্ন এনজিও তাদের এলাকায় কাজ করছে। কিন্তু তারা নারীদের কর্মের কোন ব্যবস্থা করতে পারেনি। তাদের এলাকার নারীদের বিভিন্ন ধরনের হাতে কাজের প্রশিক্ষণ দিতে পারলে, নারীরা অর্থ উপার্জন করে পরিবারের উন্নয়ন করতে পারত। তিনি বলেন, “আমি হাতের কাজ জেনে বসেছিলাম। বারসিক আমাকে সিট-কাপড় দেওয়াতে এবং গণমূখী সেলাই মেশিন সহযোগিতা করায় নিজে বাড়িতে বসে আয় করতে পারছি। আমিও কাজের পাশপাশি আমার গ্রামের ৩ জন নারীকে দর্জির কাজ শেখাচ্ছি। এক সময় তারাও আমার মত হাতের কাজ করে সংসারের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।” তার এই আয় বৃদ্ধিমূলক (লবণ মাটিতে সবজি চাষ ও দর্জি ) কাজটি দেখে অন্য নারীরা ও উৎসাহিত হতে পারে।