এসো মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনি-৩

এসো মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনি-৩

অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আবদুল আজিজ

আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥

উত্তাল ৭১। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। প্রথম সন্তান আসবে পৃথিবীতে। একদিকে আনন্দের সুখবার্তার প্রতিক্ষা আর অন্যদিকে ভয়াল সেই দিনে যুদ্ধের দামামা। পরাধীনতার শেকল মুক্তির প্রাণান্তর প্রচেষ্টায় রক্ত টগবগ করে উঠলো। পরিবারের মায়া ত্যাগ করলাম। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। কখন দেশ স্বাধীন হবে। সব সময় রক্ত টগবগ করতো পাক হানাদার বাহিনী কিভাবে খতম করবো। জীবন বাজি রেখে অসংখ্য হানাদার মারলাম। দেশ স্বাধীন হলো। ১৬ই ডিসেম্বর বাড়িতে এসেই প্রথম নবাগত সন্তানের মুখ দর্শন করি।

Manikgonj-- Abdul Aziz

এ কথাগুলো বললেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী গ্রামের অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ। ৮১ বছর বয়স। মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, দেখতে পেলাম রক্ত টগবগ করা একাত্তরের সেই যোদ্ধার চোখে-মুখে এক অনন্য উজ্জ্বল দ্যুতির আভা।

তিনি জানালেন, ‘২৬ মার্চ একমাত্র সন্তান জন্ম নিলেও তার মুখ পর্যন্ত দেখিনি। পরিবারের সকলেই জানতো আমি আর বেঁচে নেই। কেউ কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। যুদ্ধ আমাকে পরিবারের সকলের কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ছিল কিভাবে দেশ স্বাধীন করবো।’

মৃত্যুর সঙ্গে সখ্য গড়ে অসংখ্য হানাদার মারলাম। দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু আজও মুক্তিযোদ্ধারা না পাচ্ছে প্রকৃত সন্মান, না পাচ্ছে সমাজে মাথা উঁচু করে কথা বলতে। অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা এখনো মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। অথচ অনেকে যুদ্ধে অংশ না নিয়েও এখন হয়েছে বড় বড় মুক্তিযোদ্ধা। তাদের দাপটই এখন বেশি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা রয়েছে অবহেলায়।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি শেষে ২৭শে মার্চ মেজর সফিউল্লার নেতৃত্বে খাগডোর ইপিআর ঘাঁটিতে অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে শতাধিক শত্রু খতম করি। শত্রু খতমের পর রক্ত আরো টগবগিয়ে উঠে। এর পর ১৪ই এপ্রিল টাঙ্গাইলের মধুপুর ব্রিজের নিকট পাকসেনাদের সঙ্গে ভোর ৪টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে বেশ কয়েকজন হানাদার আমাদের হাতে মারা যায়। তার কয়েকদিন পর ধানুয়া কালামপুর এলাকার কালিহাতি ব্রিজের নিকট এক প্লাটুন ইপিআর এবং এক প্লাটুন পুলিশ ফোর্স, আনসার ও কিছু ছাত্র মিলে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালাই। কিন্তু আমাদের চাইতে শত্রুদের সৈন্য বেশি থাকায় আমরা পিছু হটি।” তিনি আরও বলেন, “বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী ও লতিফ সিদ্দিকী আমাকে সাহয্যে করায় সেই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যাই। শত্রুদের বুলেট আমার কান ছুঁয়ে গেলে অল্পের জন্য রক্ষা পাই। পরে ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনে চলে আসি। এরপর জুন মাসে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে ১নং সেক্টরে যোগদান করে রংপুর ও ভুরুঙ্গামারীসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকসেনাদের সঙ্গে সন্মূখযুদ্ধে অংশ নিই। আগস্ট মাসে চলে আসি নিজ জেলা মানিকগঞ্জে।” তিনি বলেন, “সাটুরিয়া ও ঘিওর থানা কমান্ডার নিযুক্ত হয়ে প্রথমে সাটুরিয়া থানার দহগ্রামের এলাহি মাস্টার ও ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীরর নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ দল গঠন করি। সর্ব প্রথম সাটুরিয়া থানা আক্রমণ করে সফল হই। এর কিছুদিন পর বারোবাইরা ব্রিজ এবং বগাধর ব্রিজে রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমণ করে সমস্ত গোলাবারুদ দখলে আনি।”

আবদুল আজিজ বলেন, “সর্বশেষ ১৪ই ডিসেম্বর সকালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ মানরা ব্রিজের সামনে পাবনা, সিরাজগঞ্জ থেকে আরিচা হয়ে পাকবাহিনীর আনুমানিক ২৩৫ সৈন্য পায়ে হেটে ঢাকা যাওয়ার সময়, সুযোগ কাজে লাগাই। তখন সিংগাইর থানার তোবারক হোসেন লুডুর দল আমাদের সহায়তা করলে শত্রুদের ওপর হামলা চালাই। সর্বশেষ সম্মুখ এই যুদ্ধে আমাদের এক যোদ্ধা চান মিয়া শাহাদৎ বরণ করেন।”
তিনি আরও বলেন, “যুদ্ধ শেষে গ্রামের বাড়ি সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লিতে ফিরে আসি। বাড়ির কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি আমি বেঁচে আছি। আমাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের সে কী কান্না! বাবাও হাউমাউ করে উঠলেন। স্বজন আর গ্রমবাসীরা দেখতে আসলো। সকলেরই চোখ ভেজা। কান্নায় চোখ দুটো ফুলে ওঠা স্ত্রী এগিয়ে আসলো, কোলে নবাগত সন্তান। সেদিন ছিল ১৬ই ডিসেম্বর। নবাগত সন্তান বুকে জড়িয়ে ধরি।”

happy wheels 2

Comments