সুন্দরবন মধুর বিশ্ব বাজার সম্ভাবনা
সাতক্ষীরা থেকে শাহীন ইসলাম
“মা, মাগো, দ্যাও মা দেখায়ে, দ্যাও কপালে ঠ্যেকায়ে
আলি আলি, হাতন তোর বালি, পাত্র না যায় যেন খালি,
গাজী বলে বন চাপলে মধু পাবে”
১৮ চৈত্র সুন্দরবনের মধূ মৌসুম। একসময় অনেক জাকজমকপূর্নভাবে এই মৌসুম উদ্বোধন রেওয়াজ থাকলে বর্তমানে তা সাদামাটা। এই দিনে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের জন্য প্রকৃত মৌয়াল, বনজীবীদের সরকারি অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। ছোট ছোট অসংখ্য নৌকা সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করতে থাকে অনুমতিপত্রের জন্য। বনবিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন, বেসরকারী সংস্থা এবং বননির্ভর জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় মিলাদ, দোয়া অনুষ্ঠান, মানত, সভা ও সংলাপ। সুন্দরবনের খলসে, কাঁকড়া, কেওড়া, গরান, বাইন ও গেওয়া গাছে অসংখ্যা ফুল ফোটে এবং ওই সব গাছের ডালে মৌমাছিরা অসংখ্য মৌচাক তৈরি করে। আগুনজালা, কালকেবাড়ি, ইলসিমারী, তালপাটি, খাজুরদানা, জলঘাটা, কস্তুরখালী,আঁঠারবেকী, লতাবেকী,কাছিঘাটা, ডিঙ্গিমারি ও বেইলা-কয়লা প্রভৃতি স্থান মধু প্রতিবেশসমৃদ্ধ অঞ্চল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিগত একবছরেও আমাদের মহামূল্যবান এই জাতীয় সম্পদের বিশ্ব বাজার সৃষ্টিতে কোন উদ্যোগ কেউ নেয়নি।
বিশ্বে একটি প্রচলিত শ্লোগানে বলা হয়েছে “নো বিজ, নো ট্রিস”নো বাইয়োডাইভারসিটি, নো লাইভলিহুড”। এই শ্লোগানকে কেন্দ্র করেই বিশ্বে এনটিএফপি (নন টিম্বার ফরেস্ট প্রডাক্ট) নামে একটি মুভমেন্ট আছে। এই আন্দোলনের অর্থ কাঠ বর্হিভিূত বনজ সম্পদের সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। গত বছর কোম্বাডিয়াতে এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত সদস্য দেশগুলো মৌমাছি, মধু, বন, পাহাড়, পরাগায়ণ, খাদ্য নিরাপত্তা, জীবন জীবিকা, ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধ, মধুর বিশ্ব বাজার পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা বিষয়ে সম্মেলন করেছে। সম্মেলনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মৌমাছি, মধু ও নির্ভরশীল জীবনযাত্রার নানান দিক নিয়ে অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়। উক্ত সম্মেলনে বারসিক বাংলাদেশের বিশ্ব ঐতিহ্য এবং আমাদের জাতীয় গর্ব ম্যানগ্রোভ বনের মধু জীবনের অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেছে। মধুর বিশ্ব বাজার, ট্রেডমার্ক, প্রোটোকল বিষয়ে হয়েছে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। ৭টি দেশের প্রতিনিধিরা মৌমাছি ও মধু জীবনের পাশে থাকার চুক্তি করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। ইতিমধ্যে ভারত, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মধূ বিশ্ব বাজারে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি দেশের ৬০ গ্রাম মধু দিয়ে মোট ৬টি দেশের মধুর আকর্ষণীয় প্যাকেজ বিশ্ব বাজারে বেশ জনপ্রিয়। প্রতি ৬০ গ্রাম মধু বিক্রি হচ্ছে ২ ডলার। তাহলে ভাবুন যে, আমাদের সুন্দরবনের মধু যদি ওই বিশ্ব প্যাকেজে অর্ন্তভূক্ত হয়, তাহলে প্রতি কেজি সুন্দরবনের মধুর দাম কত হবে? এবং আমাদের বন ও মৌয়াল জীবন কত উন্নয়ন হবে? কিংবা সরকারের রাজস্ব ভান্ডার কি পরিমাণ সমৃদ্ধ হবে? বাস্তবতা হচ্ছে আমরা এখনো পড়ে আছি প্রথাগত বাজার ব্যবস্থার মধ্যে!
তবে অনেক ক্ষুদ্র পরিসর হলেও বনজীবী মৌয়াল জনগোষ্ঠী বিগত ৯ বছর ধরে নিজেরা সংগঠিত হয়ে সুন্দরবন মধুর ন্যায্য বাজার সৃষ্টিতে সংগ্রাম করে আসছে। তারা ‘বাদাবন সম্ভার’ নামে একটি বিপণন কেন্দ্র তৈরি করেছে যার মাধ্যমে সুন্দরবনের মধুসহ সুন্দরবনের সম্পদ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ব্র্যান্ডিং করার চেষ্টা করছেন। বাদাবন সম্ভার ব্র্যান্ডিং করে তাঁরা বিক্রি করছেন সুন্দরবন মধু, কেওড়ার আচার, জেলি, চকলেট, প্রাকৃতিক মোমবাতি এবং সুন্দরবন খচিত হস্তশিল্প। প্রতিষ্ঠার ৯ বছর পর সম্প্রতি এই ‘বাদাবন সম্ভার’র সরকারি নিবন্ধন হয়েছে। সরকারের সাতক্ষীরা জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এই নিবন্ধন দিয়েছে। তবে, আমরা মনে করি, বাদাবন সম্ভারের পণ্য বিশ্ব বাজারের মানসম্মত করতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি। বিশেষ করে মধু পরিশুদ্ধ, প্রক্রিয়াজাত, প্যাকেজিং, বোতলিং, লেবেলিং বিশ্ববাজার মানের জন্য ইনোভেশন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
বলা হয়, মধু ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। মালয়েশিয়ার মধুপ্রেমী ড. হায়াতি তাঁর গবেষণায় সেটা প্রমাণ করেছেন। আমাদের সুন্দরবনের কেওড়ার আচারও ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ। কে জানে বনের এই ফল নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করা হলে এটি বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের অর্গানিক মেডিসিন হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে; বনজীবীদের জীবন ও জীবিকার জন্য উন্নয়নের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে পারে! এভাবে একটি ফল থেকে সরকার প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। আমরা মনে করি, বাজারে নানান রঙের ও ধরনের শিশু কিলার চকলেটের চেয়ে সন্তানকে সুন্দরবনের অর্গানিক কেওড়া চকলেট, জেলি ও আচার খাওয়ানোর অভ্যাস করতে পারলে, দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সহায়ক হবে। ক্ষতিকর ক্যামিকেল দিয়ে তৈরি মোমবাতি জ্বালানোর চেয়ে বাদাবন সম্ভারের অর্গানিক মোমবাতি ঘরে জ্বালালে দীর্ঘক্ষণ আলো পাওয়া, ঘরকে সুগন্ধি করে তোলা এবং স্বাস্থ্যগত ঝূঁকি থেকে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে!
ভারতের নীলগিরি পাহাড়ে আদিবাসী কুরুম্বাদের বসবাস। কুরুম্বারা তাদের মধুর ব্র্যান্ডিং করেছে ‘লাস্ট ফরেস্ট’ নাম দিয়ে এবং বিশ্ব পর্যটন স্থান উটিতে কুরুম্বাদের ‘লাস্ট ফরেস্ট’ মধু খুবই জনপ্রিয়। এমনকি বিশ্ব সেলিব্রেটি অমিতাভ বচ্চনের বিজ্ঞাপনের ডাবর মধুর চেয়েও ‘লাস্ট ফরেস্ট’ মধুর পর্যটক চাহিদা ও বিক্রি অনেক বেশি বলে জানা যায়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নিলে আমাদের ‘বাদাবন সম্ভার’ ব্র্যান্ডিং সুন্দরবনের মধুও বিশ্বে উৎকৃষ্ট মধু হিসেবে পরিচিতি পেতে পারে। বিশ্বের বাজারে প্রচলিত ডাবর, ক্যাপিলানো, প্রিমিয়াম, ক্রাউন, এসএনডব্লিউসহ অন্যান্য ব্র্যান্ডিং মধুর সাথে প্রতিযোগিতা এই ‘বাদাবন সম্ভার’ মধুও বাংলাদেশের পরিচিতি তুলতে পারে এবং বাংলাদেশের জন্য নিয়ে আসতে পারে বৈদেশিক মুদ্রাও!
অনেকের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, মধু সংগ্রহ মনে হয় বনের জন্য ক্ষতি। আসলে তা নয়। ফুলের সাথে মৌমাছির রয়েছে একটি নিবিড় সম্পর্ক। প্রকৃতিতে যখন যেখানে ফুল ফোটে সেখানে ছুটে যায় এই মৌমাছি। ঠিক সেই প্রাকৃতিক নিয়মে যখন সুন্দরবনে বিভিন্ন গাছে ফুল ফোটে তখন হিমালয় অঞ্চল থেকে মৌমাছি ছুটে আসে ফুলের ভালোবাসায়। হাজার হাজার মৌচাক ও শত শত টন মধু উৎপাদন করে তারা। এই মধু সংগ্রহ না করলে মৌমাছিরা তা খেয়ে ফেলবে, অলস হয়ে পড়বে এবং মৌসুম শেষ হলে আবারও সাইবেরিয়ার পাখির মত চলে যাবে। আর যদি সংগ্রহ করা হয় তাহলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক মৌমাছি মধু সংগ্রহে ওভারটাইম কাজ করে চাকে মধু মজুদ করতে থাকবে। ফলে বনপ্রতিবেশের পরাগায়ণের পাশাপাশি লোকালয়ের কৃষি পরাগায়ণ সম্ভব হবে। বৃদ্ধি পাবে আমাদের খাদ্য উৎপাদন, নিশ্চিত হবে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা!
মৌমাছির সাথে প্রতিটি প্রাণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মৌমাছি, মধু গাছ, মধু, মৌয়াল জীবন পরস্পর আন্তঃনির্ভরশীলতার প্রাকৃতিক বন্ধন। আমরা ইনোভেশন উদ্যোগ নিয়ে এই বন্ধনকে করতে চাই ছন্দময়! এভাবে আমাদের সুন্দরবনের মধুসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন উপাদান ও উপকরণ থেকে তৈরি করা পণ্য বিশ্ববাজার রাজত্ব করবে। আমরাও প্রমাণ করতে পারি,“সুন্দরবনের মধু পৃথিবীর সেরা মধু, পৃথিবীর সেরা ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য”। যেহেতু, এসডিজি বাস্তবায়নে বৈদেশিক সাহায্য বা অনুদানের কোন সূযোগ নেই। তাই, ‘জার্নি ফর জিরো’ স্বপ্নপূরণে সুন্দরবনের মধু, অন্যান্য বনজ সম্পদ এবং সকল জাতীয় সম্পদের উদ্ভাবনী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নত বাংলাদেশের অনেক পথ পাড়ি দেওয়া সহজ হতে পারে।