বন্যায় দূর্ভোগের শিকার নারী ও শিশুদের মানবেতর জীবন
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥
বাড়ির উঠোনে কোমর পানি গৃহবধূ রাশেদা বেগমের। পানি ঢুকে দেবে গেছে ঘরের মেঝে। স্বামী আক্কাছ আলী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার। ভ্যান চালক স্বামী, সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটছে তাদের। এর মধ্যে রাশেদা বেগম সাত মাসের গর্ভবতী। চলাফেরা কষ্টকর হলেও ইট দিয়ে চকি উঁচু করে স্বামী, ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাস করছেন। বন্যার পানি ঘরে ঢুকলেও বাড়ি ছাড়েননি তারা। কোথায় যাবেন ছেলে মেয়েদের নিয়ে। বানের কারণে স্বামীর কাজ নেই। কোথা থেকে ত্রাণও পাননি। কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি কিভাবে তারা বেঁচে আছেন। শরীরের এই অবস্থায় ছেলেমেয়েদের দুমুঠো চাল ফুটিয়ে দেবেন তারও জোগাড় নেই। প্রাকৃতিক কাজে সীমাহীন দূর্ভোগের মধ্যেই দিন পার করছেন। এবারের বন্যায় এমনই অনাকাঙ্খিত কষ্টে আছে মানিকগঞ্জের রাশেদা বেগমের মতো হাজারো নারী। আর দূর্ভোগ, দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই শিশুদের নিয়ে।
বর্ষার নয়া পানি আর নদীর স্রোতের আলাদা একটা সৌন্দর্য থাকে। যা নিয়ে কবি সাহিত্যিকরা এঁকে চলেন গল্প-কাব্য-নাট্যের নকশা। তবে, সেই পানি যদি বন্যার ভয়াবহময় রূপ নিয়ে হাজির হয় ঘরের উঠানে তাহলে সেই পানি হয়ে ওঠে সীমাহীন কষ্টের কারণ। ভোগান্তি আর জৈবিক কার্যাদির কষ্ট বহু গুণে বেড়ে যায় নারী ও শিশুদের। বিশুদ্ধ পানির অভাব আর পানিবাহিত রোগে বেশি আক্রান্ত হন শিশুরা।
সরজমিনে ঘিওরের দ্বিমুখা এলাকায় দেখা যায়, বুক সমান পানি পার হয়ে ভেজা মালপত্র রাস্তায় এনে শুকোচ্ছে বেশ কয়েকজন নারী। অনেকের রান্নাটাও চলছে নৌকায়, উঁচু চালে কিংবা রাস্তাতেই। এরই মধ্যে থেমে থেমে বৃষ্টি যোগ করছে ভোগান্তির নয়া মাত্রা। সব মিলিয়ে জেলার প্রায় ৫০ হাজার নারী-শিশুদের নাওয়া, খাওয়া, টয়লেট বা ঘুমানোর যে কতটা মানবিক কষ্ট অতিক্রম করছে, তা চোখে না দেখলে বোঝা মুশকিল।
কারো ঘরে বুক পানি, কারো ঘরে হাঁটু পানি। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। দিন চারেক আগে মাঝ রাতে হু হু করে ঢুকে পড়ে বন্যার পানি। এতে প্লাবিত হয়েছে মানিকগঞ্জের বির্স্তীণ এলাকা। বন্যার পানি বাড়তে শুরু করার পর থেকে ভোগান্তি আর জৈবিক কার্যাদির কষ্ট বেড়ে গেছে বহু গুণে। অনেইে অর্ধাহারে করছে মানবেতর জীবন যাপন। কর্মচঞ্চল খেটে খাওয়া মানুষগুলো হয়ে পড়েছে বেকার। তলিয়ে যাওয়া ফসলী জমি আর অর্ধ নিমজ্জিত বাড়ি ঘরের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে।
অপেক্ষাকৃত উঁচু অন্যের বাড়িতে, সড়ক, স্থানীয় ইউপি পরিষদ, বাঁধ ও স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যা কবলিত মানুষ। সেই সঙ্গে একই ছাউনিতে আশ্রয় মিলেছে ভেড়া, গরু ও ছাগলের। গবাদি পশু নিয়ে বেকায়দায় পরেছে কৃষকেরা। মাথার ওপরে পলিথিনের ছাউনী, ভেজা স্যাতঁস্যাতে মাটিতে রাস্তায় চট বিছিয়ে শুইয়ে আছে নারী, শিশু, বৃদ্ধ। বাড়িঘরে পানি ওঠায় কারো ভিজে গেছে কাঁথা-কাপড়, বিছানা। শিক্ষার্থীদের বইও ভিজে একাকার। সামনেই পরীক্ষা; লেখাপড়া বিঘিœত হচ্ছে মারাত্মকভবে।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর চরাঞ্চলের ১৪ বছরের শিশু আশা আক্তার। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সে। এ সময়টাতে স্কুলে সমবয়সীদের হৈ-হুল্লোড় করে, খেলার সঙ্গীদের সঙ্গে গ্রামের পথঘাট চষে বেড়ানোর কথা তার। কিন্তু বন্যায় ভিটে-মাটি ভেঙে গেছে। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে বড় হওয়ার স্বপ্ন। এ জেলার চরাঞ্চলসহ বেশ কিছু এলাকার শিশুদের ভাগ্যে ঘটেছে একই পরিণতি। বন্যার কারণে বছর বছর এভাবে স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে হাজারো শিশু। অভাব আর দুর্যোগ কেড়ে নিচ্ছে তাদের মানসিক বিকাশ, শৈশব-কৈশরের উচ্ছ্বাস।
ঘিওর উপজেলার আশাপুর গ্রামের গৃহবধূ আছিয়া বেগমের বাড়িতে কোমর পানি। বাড়ির চারদিকেও শুধু পানির ঢেউয়ের খেলা। অন্যের পরিত্যক্ত ভিটিতে নিয়েছেন আশ্রয়। আছিয়া বেগমের স্বামী আজিজ মিয়া দিনমজুরের কাজ করে। বন্যায় কর্মহীন হয়ে পড়ে তার স্বামী। স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তার কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে আছিয়ার মত এমন শত নারী।
বন্যার মধ্যে হরিরামপুর উপজেলার দুর্গম চরের বানেছা বেওয়া বের হয়েছিলেন একটু ডাল আর মরিচের সন্ধানে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাদের কিছুই খাওয়া হয়নি। বহু কষ্টে ভাত রান্না করলেও তরকারি নেই। ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী শরিফা বেগমের বাড়িতে। কিন্তু তাদের ঘরেও ডাল-মরিচ নেই। আঁচলে মুখ ঢেকে আক্ষেপের সুরে বলেন, “কোন রকমে জীবনটা বাঁচিয়ে রাখছি। বানের দিন আর শ্যাষ হয় না।”
‘খাবার নাই, টয়লেট নাই, টিউবওয়েল নাই। বউ-বেটি নিয়া বড় সমস্যায় আছি। খোলা জায়গায় থাকা যায়, কিন্তু বউ-বেটি খোলা জায়গায় শৌচ কাজ কেমন করি!’ শনিবার বিকেলে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার জিয়নপুর ইউনিয়নের স্থানীয় একটি বাঁধে আশ্রয় নেয়া এলাকায় বন্যা কবলিত মানুষদের কণ্ঠে এভাবেই প্রকাশ পায় পরিস্থিতির নাজুকতা।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে ছুঁই ছুঁই পানি। প্লাবিত পাথারের মধ্যে মাথা জাগিয়ে রাখা রাস্তাটির প্রায় তিন কিলোমিটার জায়গাজুড়ে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যায় সব হারানো প্রায় শতাধিক পরিবারের সদস্যরা। গবাদি পশুর সঙ্গে পাশাপাশি রাত কাটাচ্ছেন আশ্রয় নেওয়া বানভাসিরা। পুরুষরা নিজেদের দুর্ভোগ মেনে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন, কিন্তু তাদের স্ত্রী-কন্যাদের এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করার আকুতি জানান তারা।
বিশিষ্ট নারী নেত্রী ও মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক লক্ষ্মী চ্যাটার্জ্জী বলেন, “বন্যায় সবচেয়ে বেশি দূর্ভোগের শিকার হন নারীরা। খাবার-সন্তান আগলে রাখা ও পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থায় নারীরা মানবেতর জীবন যাপন কেরন। তাই মানবিক বিপর্যয় এড়াতে যার যার অবস্থান থেকে বানভাসী মানুষের পাশে যেন আমরা দাঁড়াই। এটা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।”