গ্রামীণ নারীর সুস্বাস্থ্যের জন্য চাই ধোঁয়াবিহীন উন্নত চুলা

মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম
জ্বালানি গ্রামীণ নারীর নিত্য দিনের সঙ্গী। শুধু তাই নয়; সরাসরি প্রচলিত জ্বালানির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে এ দেশের কয়েক লাখ গ্রামীণ নারী। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সনাতনী বা প্রচলিত চুলা ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি পুড়িয়ে যতটুক তাপশক্তি পাওয়া যায় তার শতকরা ৫-১৫ ভাগ কাজে লাগে। বাকি ৮০-৮৫ ভাগ শক্তি অপচয় হয়। এছাড়া চুলায় সৃষ্ট বিষাক্ত উষ্ণ গ্যাস, অদহনকৃত কণা ও ধোঁয়া প্রভৃতি ব্যবহারকারির পক্ষে অনেক ক্ষতিকর। এই ভাসমান ধোঁয়া পরিবেশ দুষণের জন্যও অনেকাংশে দায়ী। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে যারা অনুন্নত চুলায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে রান্না এবং পানি গরম করে থাকে তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যহীনতা এবং মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো এই চুলা হতে নির্গত ধোঁয়া।

DSC00408
বাংলাদেশের দরিদ্র নারীরা নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। কিছু সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। কিন্তু অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কে আমরা জানি না কিংবা আদৌও আমলে রাখি না। তেমনি একটি স্থাস্থ্য ঝুঁকির ক্ষেত্র হচ্ছে প্রতিদিনকার রান্নার কাজে ব্যবহৃত জ্বালানি। প্রতিদিন কাঠ, খড়, ডালপালা, পাতা কিংবা গোবর পুড়িয়ে গ্রামের প্রতিটি পরিবারের রান্না করা হয় প্রচলিত চুলা ব্যবহার করে। কিন্তু এই চুলায় যতটুকু জ্বালানি ব্যবহার করা হয় সে অনুপাতে তাপশক্তি কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। অন্যদিকে এটি তাপ এর পাশাপাশি প্রচন্ড ধোঁয়া উৎপন্ন হয়। এই তাপ এবং ধোঁয়া রান্নাঘরের আবস্থান এবং নির্মাণগত ত্রুটির কারণে যিনি রান্না করেন- তিনি প্রচন্ড ভোগান্তির শিকার হয়। এই বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের রয়েছে নানান ধরনের অবহেলা। এটি যেহেতু নারীদের একান্ত নিজস্ব বিষয়- তাই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা অন্যান্য নারী সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মতো এই বিষয়টিকে অবহেলার চোখে বিবেচনা করে কিংবা এড়িয়ে যায়। এই স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে উত্তরোনের জন্য প্রয়োজন পরিবরের নারী সদস্যসহ সকলের সচেতনতা। পাশাপাশি অধিক তাপ এবং কম ধোঁয়া উৎপন্নকারী চুলা নির্মাণ। একই সাথে রান্নাঘরটিকে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচল করে এমনভাবে নির্মাণ করা।

DSC00409
জ্বালানির সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে নারীদের সচেতন করে তোলার জন্য গত ৪ মার্চ, ২০১৭ তারিখে মানিকগঞ্জ  জেলার ঘিওর উপজেলার বাইলজুরি-সাইলকাই ও বিলরসিংজুরী গ্রামের অধিবাসীদের নিয়ে এলাকার জামিলা খাতুনের উঠানে জ্বালানি নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের করণীয় শীর্ষক এক দলীয় সভায় রেহেনা বেগমের সভাপতিত্ত্বে গৃহীনিরা তাদের জ্বালানি বিষয়ে বিভিন্ন সমস্যা ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। নার্গিস আক্তার বলেন, “আমার মায়েরা প্রচলিত চুলায় রান্না করতে অভ্যস্থ। আমরা এখনো এটি ত্যাগ করতে পারিনি। তবে আমি টিভিতে উন্নত চুলার আলচনা শুনেছি এবং গ্রামীণ শক্তির চুলা তৈরির প্রক্রিয়া দেখেছি। সেটি অনুসরণ করে বাড়িতে নিজের মতো করে একটি চুলাও বানিয়েছি। এই চুলায় ধোঁয়া কম লাগে, রান্না তাড়াতাড়ি হয় এবং জ্বালানি কম লাগে। আমি এ কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।” তিনি আরও বলেন, “এখন অনেকেই আমার দেখাদেখি এই চুলায় রান্না করছে। আমি আমার প্রতিবেশীর মধ্যে কয়েকজনকে দেখিয়ে দিয়েছি কিভাবে এই চুলা বানাতে হয় এবং রান্না করতে হয়।” মালেকা বেগম বলেন, “উন্নত চুলার কিছু অসুবিধাও রয়েছে- যেকারণে অনেকেই ব্যবহার করতে চায় না। যেমন-এই চুলায় বড় রান্না যেমন ধান সিদ্ধ করা যায় না। সব লাকড়ি দিয়েও রান্না করা যায় না। তারপরও ধোঁয়া কম লাগে বিধায় আমরা এই চুলা ব্যবহার করছি।” আকলিমা আক্তার বলেন, “সিমেন্টের তৈরি উন্নত চুলার চেয়ে মাটির তৈরি উন্নত চুলা অনেক ভালো।” দলীয় আলোচনা শেষে অংশগ্রহণকারীরা তাদের প্রত্যেক বাড়ী হবে একটি করে সবুজ জ্বালানির মডেল এবং সবুজ জ্বালানির পাঠশালা। তারা ধোয়াবিহিন চুলা প্রতিযোগিতা বা মেলার আয়োজনের কথা বলেন।

মানুষের প্রয়োজনেই প্রতিটি আবিষ্কার করেছে। আবার সময়ের সাথে সাথে সেই আবিষ্কারটি দিনকে দিনকে উন্নত হয়। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ রান্নার চুলা দেখলে মনে হয় এটি যেমনভাবে আবিষ্কার হয়েছে তেমনভাবে রয়েছে। এটির উন্নয়ন একটি নির্দিষ্ট সময়ের গন্ডিতেই আবদ্ধ। সময় এসেছে পরিবর্তনের- শুধু প্রযুক্তিক দিক দিয়ে নয়; স্বাস্থ্য, সময় এবং টেকসই এর বিবেচনায়।

happy wheels 2

Comments