হাট কুড়ানী কমলার জীবন সংগ্রাম
সাতক্ষীরা থেকে চম্পা রানী মল্লিক
জীবন যেখানে যেমন। জীবন যুদ্ধের কতই না কাতর গল্প রয়েছে। আমরা কতখানি খবর রাখি সেকল বেদনার। কমলা বালা ঢালী (৮০)। স্বামী পাগল ঢালীর মৃত্যুর পরে কমলার জীবনে নেমে আসে চরম দূর্ভোগ। জীবন যুদ্ধে হার না মানা কমলা বালা সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের হরিনগর বাজারে বাজার খাবার কুড়িয়ে এগিয়ে চলেছেন সামনের দিনগুলোতে।
কমলার বাবার বাড়ি ছিল মিরগাং। স্বামীর বাড়ি বানেখালী। কমলার বিয়ে হয়েছিল মিথ্যা পরিচয়ে। কারণ কমলার স্বামী তার পরিবারে প্রস্তাব দিয়েছিল এই বলে যে, তার স্ত্রী মারা গেছে। সংসারে ছিল শুধু কমলার মা ও এক ভাই। কমলার বাবার মৃত্যুর পরে কমলা তার মায়ের সাথেই থাকতো। এই প্রস্তাবে কমলার পরিবার রাজী হয়ে যায়। বিয়ে হয়ে যায় কমলার। বিয়ের ৩/৪ মাস পরে কমলার স্বামী তার প্রথম পক্ষের স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসে। জানতে পারে তার সতীন রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তখনই কমলা বুঝতে পারে যে, তার স্বামী তাকে কতটা মিথ্যা বলেছে, কতটা ঠঁকিয়েছে। তখন থেকে সে হয়ে গেল কাজের মানুষ। সংসারের সমস্ত কাজ তাকে করতে হতো, এমনকি ব্যবহারটাও কাজের মানুষের মতো করা হতো। সারাদিনের খাটুনির পরে তার থাকার জায়গা হতো ঘরের বারান্দায়। এভাবে তার সতীন ও সতীনের ছেলে মেয়ে তাকে জালা যন্ত্রণা দিতো। কিন্তু এত কিছুর পরেও সে তার স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে সেখানে থাকতো। কারণ তার স্বামী তাকে ভালোবাসতো এটা সে জানতো। গোপনে অনেক যত্নও করতো। তবু ও সে তার স্বামীর এত বড় মিথ্যা কথাটা বাপের বাড়িতে জানাবে ঠিক করলো। কিন্তু তাকে বাপের বাড়ি পাঠানো হতো না। হঠাৎ একদিন তার বাপের বাড়ির পাড়ার একজনের সাথে দেখা হল তার। তখনই তার মাধ্যমে সংবাদটি পাঠালো সে। ঠিক তখনই আবার শরনার্থী (মুক্তিযুুদ্ধের সময়) ঝামেলা বাঁধে। তখন তার স্বামী ১ম স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে চলে যায়। আর নিঃস্ব কমলা চলে যায় তার মায়ের কাছে। সেখান থেকে মা ও ভাইকে নিয়ে তারাও চলে যায় ভারতে। পরিবেশ শিথিল হলে তারা আবার চলে আসে বাংলাদেশে তাদের ভিটায়। সেখানে থেকে দিনমজুরী কাজ করে, নদীতে মাছ ধরে সংসার চালায় কমলা ও তার ভাই।
শুধু সংসার চালানো নয়, পাশাপাশি কিছু সঞ্চয়ও করতো সে। তিন বছর পর তার স্বামী তাকে নিতে আসে। বাড়ির সবাই তাকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ততদিনে তার স্বামীর বসতভিটা হয় রাঙ্গামাটিতে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সরকারিভাবে তারা এই জায়গাটি পায়। তবে এই জায়গাটি হয়েছিল তার ১ম পক্ষের স্ত্রীর নামে। আর তাই সেখানে গিয়ে কমলার সুখ হলো না। কষ্টে পার হতে থাকলো তার দিনগুলো। এভাবে এক একটা দিন পার করতে করতে তার দুই বছর পার হয়ে গেল অনেক জ¦ালা-পোঁড়ার মাঝ দিয়ে। তার সতীন তাকে প্রচুর খাটাতো, কিন্তু কোন প্রতিবাদ করার ক্ষমতা ছিল না তার স্বামীর। কিন্তু কমলা ভাবলো এভাবে চলতে থাকলে আমি বাঁচবো না, আবার আমি যে মায়ের কাছে চলে যাবো তাও পারছি না। কারণ পথও চিনি না। কি হবে উপায়?
ঠিক ওই সময় দক্ষিণ অঞ্চল থেকে কিছু মানুষ বন কাঁটতে যায় রাঙ্গামাটিতে, কথা প্রসংগে জানতে পারে কমলা। তারপর সে তাদের সাথে যোগাযোগ করে চলে আসে বাবার বাড়িতে। তখন তার ছেলের বয়স ৭ বছর ও মেয়ের বয়স ২ বছর। সবকিছু জানায় মা ও ভাইকে। বসে থাকেনি সে, আবারো করতে থাকে অক্লান্ত পরিশ্রম।
এভাবে সে তার সঞ্চিত টাকা থেকে ১০ কাঠা জায়গা কেনে। সেখানে ছোট একটি কুঁড়েঘর বেধে বাস করতে থাকে সে তার ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে। আর স্বপ্ন দেখে ছেলে মেয়ে বড় হলে একদিন তার সুখ ফিরে আসবে। ছেলে ও মেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর সক্ষমতা ছিলনা তার। ছেলে একটু বুঝতে শিখলে লোকের বাড়িতে মাইনা থাকলো আর মেয়েটি বাড়িতে থাকতো সংসারের কাজে সহযোগিতা করতো।
এভাবে মেয়ের বয়স যখন ১২ বছর তখন তাকে বিয়ে দিল, পাশের গ্রামের ছেলে শরৎ এর সাথে। সেখান থেকে দুই বছর পর ছেলেকে বিয়ে দিল। অভাবের সংসারে মাস খানেক যেতে না যেতেই বৌমা চাইলনা যে তার শাশুড়ী তার সংসারে থাকুক। এ নিয়ে সবসময় অশান্তি করতো তার বৌমা। কমলা চাইলনা তাকে নিয়ে অশান্তি বাড়–ক,আর তাই সে আলাদা হয়ে গেল। এমন বয়সে এসে কিভাবে চলবে সে? খাবে কি? বাঁচবে কিভাবে? অন্যদিকে মেয়েটির সংসার ও সচ্ছ্বল নয়। জামাই চৌকিদারী করে যা পায় তাতে তাদের নিজেদেরই চলেনা ঠিকমত এরকম বিভিন্ন চিন্তা তাকে আকড়ে ধরে। তবু ও সাহস হারায়নি সে।
নদীতে জালটানা, লোকের বাড়ি দিনমজুরীর কাজ এবং পাশাপাশি হাট কুড়াতেন তিনি। হাট কুড়িয়ে সারাদিনে যা পেতো তা ছেলে ও মেয়েকে দিয়ে খেতো সে। এত কিছুর পরেও আগলে রাখতে পারলোনা তার ছেলেকে। বৌ এর কথামত তার মাকে ছেড়ে চলে গেল ভারতে।
কমলার কষ্টে কেউই চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। তবুও বুকে পাথর বেঁধে কমলা চলছে তার গতিতে। কমলা সপ্তাহের একদিন শুক্রবারে যেদিন হরিনগর বাজারে হাট বসে সেদিন তার গ্রাম ধল থেকে দেড়/দুই কিলোমিটার মাটির পথ ধরে চলে আসে সে বাজারে। সকল দোকানদাররা আসার আগেই সে উপস্থিত থাকে। যখন যে দোকানদার, যে কাজ বলে তা কমলা করে দেয়। এভাবে সারাদিন শেষে দোকানদাররা তাকে করে খারাপ ভাল মিলিয়ে কিছু মাল ও কেউ কেউ কিছু টাকা দেয়। এগুলো নিয়ে কাঁচা পথ ধরে একটু পর পর থেমে বাড়ি যেতে তার সন্ধ্যা নামে। এভাবে সারা সপ্তাহের তরকারী তার যোগাড় হয়। আর বাকি দিনগুলি সে দিনমজুরী ও নদীতে মাছ ধরে চলতো। কিন্তু, বয়স বেশি হওয়ায় সেগুলো আর পারে না। বেছে নিল আর একটি কাজ। লোকের ঘেরে মাছ বেছে দেওয়া এবং কিছু মাছ চাওয়া। এভাবে তার মাছটাও যোগাড় হয়। প্রতিনিয়ত মাছ পেয়েই যে সে সব খেয়ে ফেলে তা নয়, মেয়েকে দেয় এবং কিছুটা শুকিয়ে রাখে চৈত্র ও বৈশাখ মাসের জন্য। যখন সমস্ত ঘের গুলো শুকিয়ে দেওয়া হয়। জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে নদী থেকে ভেসে আসা ফল ও পাতা। এছাড়া অনেক কষ্ট ও হাঁটাহাটির পরে তার একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড হয়। এই টাকা দিয়ে সে চাল ও তেলটা কেনে এবং অনেক হিসাব করে চলেও এই টাকায় বছর তুলতে পারে না সে।
অনেক কষ্ট করে দিন পার করতে হয় তাকে; মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকে। এছাড়াও কমলা সারা বছরের কথা ভেবে কষ্ট হলেও কখনো এক বেলা, আবার কখনো বা দিনের দুটি বেলাই না খেয়ে থাকে। এই হল কমলার জীবন। সুখ পাইনি সে কখনো। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অবিরাম যুদ্ধ করেই চলছে কমলা। হাট কুড়ানী কমলা বালা জীবনের সকল দুঃখ ও কষ্টকে পেছনে ফেলে নিজের পরিবার এবং নিজের জীবনকে যেভাবে উৎসর্গ করেছেন সে অনুপ্রেরণা মানুষের বেঁচে থাকার পথকে মসৃণ করবে।