সজিনা : বরেন্দ্র্র অঞ্চল উপযোগি খাদ্য ও ঔষধি বৃক্ষ
রাজশাহী থেকে ইসমত জেরিন
বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমের অঞ্চল এর ভৌগলিক পরিচয় বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে ১৯২৮ সালে জন কার্টার সেটেলমেন্ট রিপোর্টে বরেন্দ্র অঞ্চলকে উঁচু, উন্মুক্ত, বন্ধুর ভূমি, উপত্যকার মাঝ দিয়ে সরুনালা প্রবাহিত, গ্রীষ্মকালে শুধু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও বনের ভগ্নাংশ ব্যতীত সমগ্র বরেন্দ্র ছায়াহীন ধু-ধু প্রান্তর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কর্কটক্রান্তি রেখা এ অঞ্চলের দক্ষিণে অবস্থান করায় এখানকার জলবায়ু সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ একবারেই কম। মাটি এঁটেল ও ক্ষেত্র বিশেষে এঁটেল দো আঁশ এবং গ্রীষ্মকালে শুকনো অবস্থায় খুব শক্ত এবং রসধারন ক্ষমতা খুবই কম। আর বর্ষাকালে কাদাযুক্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর ও ভোলার হাট, নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর, সাপাহার, পোরশা, পতœীতলা, দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ, ঘোড়াঘাট, বিরামপুর, হাকিমপুর, বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম, কাহালু, জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালের মৃত্তিকা খুবই এঁটেল ও কাদাযুক্ত। উপরের মাটির স্তর অত্যন্ত কঠিন এবং পানি অপ্রবেশযোগ্য। মাটিতে জৈবস্তরের পরিমাণ অত্যন্ত কম। মাটির গঠন দূর্বল ও অম্লভাবাপন্ন। তাই বরেন্দ্র অঞ্চলে এমন সব বৃক্ষ (নিম, তাল, খেজুর, বাবলা, কড়ই, সজিনা) রোপন করা উচিত যা মাটির রস ধরে রাখবে এবং এলাকা উপযোগিতা রক্ষায় ভূমিকা পালন করবে।
সজিনা
সজিনা বরেন্দ্র এলাকা উপযোগি একটি অন্যতম বৃক্ষ। যার বৈজ্ঞানিক নাম Moringa oleifera Lamk; ইংরেজী নাম Drumstick। এটি একটি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। যা উচ্চতায় ৩০ ফুট বা তার অধিক লম্বা হয়ে থাকে। ফুল সাদা, ফল লম্বা, বীজ পক্ষল, অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফুল হয়। অঙ্গজ অংশের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার করা যায়। বাংলাদেশে মূলত ৩ ধরনের সজিনা পাওয়া যায়। যথা: শ্বেত সজিনা, রক্ত সজিনা ও নীল সজিনা। অঞ্চলে ভেদে শ্বেত সজিনাকে সজিনা আর রক্ত সজিনাকে লাজনা বা নজিনাও বলে থাকে। গোদাগাড়ী ও তানোর এলাকার মানুষ সজিনাকে ছুটি নামেই ডেকে থাকে। সজিনার আদি নিবাস হিসেবে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল ও পাকিস্তানকে ধরা হয়।
বরেন্দ্র এলাকা উপযোগিতা সজিনা
সজিনা বৃক্ষরোপনের জন্য সবসময় শুষ্ক আবহাওয়া প্রয়োজন। পুষ্পায়ন ও ফল ধারণ উভয় সময়েই আকাশ কুয়াশা মুক্ত, তুষারমুক্ত, মেঘমুক্ত আবহাওয়ার প্রয়োজন হয়। অতিরিক্ত বায়ুমন্ডলীয় আর্দ্রতায় পোকামাকড় আক্রমণ বেশী হয় এবং জলাবদ্ধ মাটিতে গাছের ফুল ও ফল ধারণ ব্যাহত হয় বলে জলাবদ্ধতা সজিনা গাছ সহ্য করতে পারে না। সজিনা গাছের জন্য ৭৫০-২১২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত সর্বোত্তম। এই বৈশিষ্ট্যসমূহ বিবেচনায় সজিনা বৃক্ষ বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য খুবই উপযোগি একটি বৃক্ষ।
পথ্য ও চিকিৎসায় সজিনা বৃক্ষ
“আমার ছেলে মেয়ের যখন খুব জ্বর হয়, মুখে রুচি আসে না কিছু খ্যাতে পারে না তখন মুখের রুচি আনার জন্য আমি সজিনার পাতা ভাজি করে খালি মুখে খ্যাতে দিই। তখন ওদের মুখের রুচি ফিরে আসে আর গায়ের ব্যথায়ও আরাম পায়”। সজিনার উপকারিতা সম্পর্কে এভাবেই বললেন গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়ন এর বড়শীপাড়া গ্রামের মোছা. রুবিনা বেগম। সজিনার ব্যবহার সম্পর্কে বটতলী গ্রামের মোছা. তানজিলা বেগম বলেন, “সর্দি হলে বাজারের ঔষধ খেলে কফ বশে যায়, ঘুম পায়, শরীরে অন্যান্য প্রতিক্রিয়া হয়। কিন্তু সজিনার ডাটা খেলে সর্দি ভাল হয় এবং অন্য কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় না। এছাড়াও শরীরের কোন স্থানে ফুলে গেলে, ব্যথা হলে সজিনার শিকড় বেটে প্রলেপ লাগালে ব্যথা ও ফোলা দুটোই সেরে যায়। সজিনা পাতার রস লবণের সাথে মিশিয়ে খেলে বাচ্চারা পেটের গ্যাস থেকে আরাম পায়।”
আসুন সজিনা গাছ রোপণ করি
সজিনার পুষ্টিগুণ ও উপকারিতার জন্যই গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের বড়শীপাড়া গ্রামের আলোর পথে তরুণ সংঘের সদস্যরা মিলে প্রাথমিকভাবে তাদের গ্রামে সজিনা গাছের জরিপ করে। জরিপের পর গ্রামের যাদের বাড়িতে সজিনা গাছ নেই অথচ জায়গা আছে এবং গাছ লাগাতে ইচ্ছুক এমন বাড়িগুলোতে নারী সংগঠনের উদ্যোগে গাছ বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেসব নারী সদস্যেরা গাছ বিতরণ করতে পারবে তাদের থেকে অন্য ১৫জন নারীকে একটি করে সজিনা ও একটি করে লাজনার গাছ দেয়া হবে। এ সম্পর্কে মুন্জিলা বেগম বলেন, “একটি সজিনা গাছ থেকে যেমন আমি টাটকা সবজি খেতে পারব; তেমনি সারা বছর ফল হওয়ায় পাড়াপ্রতিবেশীদেরও দিতে পারব, নিজেরও উপকার হলো, অন্যদেরও উপকার হলো।”
ভূগর্ভস্থ বেশি পানি শোষণকারি, স্বাস্থ্য সমস্যা (শ্বাস কষ্ট, হাঁপানি) বৃদ্ধিকারক ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি এবং বিদেশি গাছ না লাগিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূমির উপযোগি সজিনা বৃক্ষ কমিউনিটি ভিত্তিক রোপণ করা দরকার। যা আমাদের পুষ্টি উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বড়শীপাড়া গ্রামের নারীদের মতো বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধরে রাখতে তাই আপনিও আপনার বাড়ির পাশে ১টি করে সজিনা গাছ লাগান।