পিঠা উৎসব বাঙালির একটি লোকজ সংষ্কৃতি
সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান
বাঙালিরা সব সময়ই উৎসব মুখর। সময় ভেদে তারা নানা উপলক্ষে নানা ধরনের উৎসবে মেতে থাকে। বাঙালির ইতিহাস থেকেই এ দেশের উৎসবপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ অসম্প্রাদায়িক চেতনার একটি অপূর্ব সংমিশ্রণ রয়েছে এদেশে। কিছু উৎসব এখনো এদেশে সামাজিক ও সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পালিত হয়। হাজার বছরের গ্রামীণ ও লোকজ সংষ্কৃতিকে ধারণ করে বাঙালির বেড়ে উঠেছে। বাঙালি সংষ্কৃতি ও ঐতিহ্যের আসল রূপ প্রকাশ পায় বৈশাখি উৎসব, নবান্ন উৎসব, সাকরাইন, পৌষ পার্বণে পিঠা উৎসবের মত বহুমাত্রিক উৎসবের মাধ্যমে। এ ধরনের উৎসব বাঙালির মধ্যে গড়ে তুলেছে এক সৌহার্দ্য ও সম্প্রতির বন্ধন। তাছাড়া বাঙালিরা অত্যন্ত ভোজন রসিক হওয়ায় তাদের মধ্যে রয়েছে বহুমাত্রিক খাদ্য সংষ্কৃতির বৈচিত্র্যও। ভাতের পর বাঙালিরা খাদ্য সংষ্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন নানা ধরনের পিঠা পুলিতে।
এদেশের লোকজ ঐতিহের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে পিঠা পুলি। প্রচলিত পিঠায় ধরে রাখে আত্মীয়ের বন্ধন। আত্মীয়দের বাড়িতে বাড়িতে পিঠা পাঠানো বাঙালির সমাজ সংষ্কৃতির বড় একটি রীতি। পিঠা পুলির আয়োজন যেমন সামাজিক সম্পৃীতির বন্ধন সুদৃঢ় করে তেমনি পিঠা বাহারি রকমের পিঠা তৈরির মাধ্যমে নারী সমাজের নিপুণ ও শৈ^ল্পিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে। কিন্তু মানুষের রুচির পরিবর্তন এবং আধুনিক ফাস্টফুড প্যাকেট জাত খাদ্যের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে লোকজ ঐহিত্যের নিরাপদ খাদ্য সংষ্কৃতি বাঙালির পিঠা উৎসব। তাই মুখরোচক খাবার হিসেবে পিঠার স্বাদ গ্রহণ ও জনসন্মূখে একে আরো পরিচিত করতে লোকজ এই ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মমের কাছে তুলে ধরতে সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের ব্রী কালিয়াকৈর নয়াপাড়া কৃষক কৃষাণি সংগঠন বারসিক’র সহায়তায় বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য প্রচারাভিযান গ্রামীণ পিঠা উৎসবের আয়োজন করে সম্প্রতি।
উৎসবে নতুন প্রজন্মের ছয় বছর বয়সি শিশু সাদিয়ার স্বাদ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে বারসিক কর্মকর্তা শাহীনুর রহমানের সঞ্চালনায সংগঠনের সভাপতি মো. হযরত আলীর সভাপতিত্বে আলোচনা করেন মানিকগঞ্জ জেলা নারী উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সেলিনা বেগম, সমাজ সেবক মো. মফিজুল ইসলাম মজনু, প্রবীণ নারী , জোবেদা বেগম, রুপশি বেগম, হালিমা বেগম, উজালা বেগম, প্রবীণ কৃষক মো. আশোক আলী, বারসিক কর্মকর্তা শিমুল কুমার বিশ^াস। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বারসিক কর্মকর্তা শারমিন আক্তার, অনন্যা আক্তার ও সঞ্জিতা কির্ত্তুনিয়া প্রমুখ।
আলোচনায় বারসিক কর্মকর্তা শিমুল কুমার বিশ্বাস পিঠা উৎসবের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘পিঠা বাঙালির চিরায়িত সংষ্কৃতি। এই পিঠাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক তৈরি হয়। পিঠার তৈরি উপকরণের সাথে অনেক ধরনের পেশা টিকে থাকে। তাছাড়া পিঠা আমারা বাড়িতে তৈরি করতে পারি বলে এটি আমাদের নিরাপদ খাদ্যের অন্যতম উৎস।’ প্রবীণ কৃষাণি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘আমি আমার দাদীর কাছে নানা ধরনের পিঠা তৈরি করতে শিখেছি। আমি আমার বাড়িতে নাতনীদেরকে পিঠা তৈরি করা শিখানোর চেষ্টা করছি।’ জোবেদা বেগম বলেন, ‘এমন এক সময় ছিল যখন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানোর রীতি ছিল। পিঠা দিয়ে আত্মীয়স্বজন ও অতিথিদের আপ্যায়ন করা হতো। কিন্তু এখন এই রীতিতে যেন ভাটা পড়েছে। শীতের সময়ে এখন আর আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসেন না। এর ফলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’ প্রবীণ কৃষক মোঃ আশোক আলী বলেন, ‘শহরের মত গ্রামেও এখন পিঠা পুলির আয়োজন আগের মত হয় না। পিঠার সাথে আবহাওয়া ও কৃষি একটি সম্পর্ক ছিল। বর্ষা মৌসুমে পানি হতো, আউশ, আমন, ডেপু, মধুশাইল, কটতারা, মরিচফুল আম শাইল নানা ধরনের ধান চাষ হতো। এসকল ধানের পিঠা সবচেয়ে বেশি ভালো হতো। প্রচুর পরিমাণে খেজুর গাছ থাকায় গুড় থাকতো প্রচুর। কিন্তু আবহাওয়া প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়া খেজুর গাছও নাই, দেশী জাতের ধানের চাষ খুব হয় না তাই পিঠা তৈরি করতে যে উপকরণ লাগে তা হারিয়ে গেছে। মফিজুল ইসলাম মজনু বলেন, ‘পিঠা উৎসব বাঙালির একটি লোকজ সংষ্কৃতি। এই সংষ্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা ও নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এই সংষ্কৃতি ধরে রাখতে হলে প্রাকৃতিক পরিবেশও রক্ষা করতে হবে।।’
উল্লেখ্য ২৫ জন নারী দুধ চিতই, ভাপা, মোড়গ সংশা, দুধ কলি, সেমাই, ডোবা, জগদানা, পাটিসাপটা, ছিটরুটি, আজিজকুলি, পাকন, তিলকুলি, মধু, চিতই, বেনি, শামুক, ফুল, সিদ্ধকুলি, তেলচিতি, মুগশালা, মুষ্ঠি, তাল, ছেইপাকান, আনদশা, পোয়া, মিষ্টি বড়াসহ ২৫ ধরনের পিঠা উপস্থাপন করেন এবং ৭০ জন নবীন প্রবীণ শিক্ষার্থী উৎসবে অশগ্রহণ করেন।