পৌষ উৎসব: বাঙালির ঐতিহ্য
মানিকগঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার
পৌষ বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটা বিশেষ উৎসব বা বিশেষ ঐতিহ্যবাহী দিন। বাংলা মাসের হিসাব অনুয়ায়ী পৌষ মাসের শেষ দিনটিতে এই উৎসব পালন করা হয়। বাঙালি হিন্দু নারীরা এই দিনে বিভিন্ন ধরণের পিঠা, পুলি, পায়েশ বানানোর মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করে। কালের বিবর্তনে এই উৎসব বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়েছে। যে কোনও উৎসবের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে মানুষের মিলনের আনন্দ বার্তা। আত্মীয়-পরিজনের আগমনে উৎসব পূর্ণতা লাভ করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়ে থাকে। পুরান ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তি সাকরাইন নামে পরিচিত। পৌষ সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে মেলা বসে। বিভিন্ন ধরণের খেলা, গরু দৌড় ও বাউল গানের আসর বসে।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/01/140024988_479005443085318_635486498663051374_n-1024x573.jpg)
সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যের এক রাশি হতে অন্য রাশিতে সঞ্চার বা গমন করাকেও সংক্রান্তি বলা যায়। সংক্রান্তি শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও একই অর্থ পাওয়া যায়। সং+ক্রান্তি, সং অর্থ সঙ সাজা এবং ক্রান্তি অর্থ সংক্রমণ। অর্থাৎ, ভিন্ন রূপে সেজে অন্যত্র সংক্রমিত হওয়া বা নতুন সাজে, নতুন রূপে অন্যত্র সঞ্চার হওয়া বা গমন করাকে বোঝায়। সূর্য এ দিনই ধনু থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। এর থেকেই মকর সংক্রান্তির উৎপত্তি।
একটা সময় ছিল যখন এই পৌষ সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে শ^শুর বাড়িতে জামাই আসতো বেড়াতে। সারাপাড়া একসাথে চলতো পিঠেপুলি বানানোর ধুম। উৎসবমূখর থাকতো সারা পাড়া। কিন্তু বর্তমনে যৌথ পরিবার ভেঙে গড়ে উঠেছে একক পরিবার। নারীরাও আজ বিভিন্ন রকম কর্মব্যস্ততায় সময় অতিবাহিত করছে। নানী, দাদী, মায়ের হাতের পিঠাপুলি খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আজ আর সময় হয়ে উঠে না ব্যস্তময় মানুষের। গ্রামের শিশুরা এখনো দু.একটি পিঠা পুলির নাম জানলেও শহরের শিশুরা জানেনা এসব পিঠার নাম। অনেক শিশুর এই পিঠা খাওয়ার সৌভাগ্যও হয়নি তার দাদী, নানীর হাতে। কিন্তু বর্তমানে শহরের বিভিন্ন দোকানের বদৌলতে শহরের শিশুরা চিতই পিঠা ও ভাপা পিঠা চিনতে সক্ষম হয়েছে। দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের বাংলার ঐতিহ্য পিঠাপুলি।
উদীচী, মানিকগঞ্জ জেলা সংসদ এর আয়োজনে পালিত হলো পৌষ উৎসব ১৪২৭। গত ১৪ জানুয়ারি উদীচী কার্যালয়, মানিকগঞ্জ এ এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। বারসিক বিভিন্ন নারী উদ্যোক্তাদের তৈরিকৃত নানা ধরণের পিঠাপুলির সঙ্গে নতুন প্রজন্মের শিশুদের সাথে পরিচয় করানোর পাশপাশি চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলার এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে নারীদের এই ধরণের উদ্যোগগুলোকে সামনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছে। বারসিক এর সহযোগিতায় সীমা’স ফুড (সীমা খান) এই পৌষ উৎসবে পিঠাপুলির স্টল দেয়। স্টলে স্থান পায় চিতই, ভাপা, পাটিসাপটা, মোরগ শংশা, মালপোয়া পিঠা।
উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌস। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মেয়র গাজী কামরুল হুদা সেলিম, এ্যাডভোকেট দীপক কুমার ঘোষ, জাতীয় মহিলা সংস্থা, মানিকগঞ্জ শাখার সভাপতি শ্রীমতি লক্ষ্মী চ্যাটার্জী বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও শিশুরা। পৌষ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রকম পিঠাপুলি, বাউল গান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/01/140306071_425058155409101_264369926410754722_n-1024x846.jpg)
পৌষ উৎসব, বাঙালির ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে গ্রাম বাংলার নারীরা তাঁদের বংশ পরম্পরায় চর্চার মধ্য দিয়ে ধারণ করে যাচ্ছে। পিঠাপুলি শুধু বাঙালির খাওয়ার উৎসব নয়। এর মধ্যে রয়েছে মমতা, ভালোবাসা ও আন্তঃনির্ভরশীলতা। এই আন্তঃনির্ভরশীলতার চর্চা অব্যাহত থাক যুগের পর যুগ। সকলের পারস্পরিক সহমর্মিতা ও আন্তঃনির্ভরশীলতার ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক বহুত্ববাদী সমাজ।