বৈচিত্র্যপূর্ণ ধানের জাত চাষ করি
মানিকগঞ্জ থেকে বিমল চন্দ্র রায়
মানিকগঞ্জ জেলার ধামসর, উলাইল, চকমিরপুর, বড়টিয়া, বাইলাখোড়া, নালী, শিমুলিয়া, পুটাইল, ভাড়ারিয়া, চালা, গালাসহ অন্যান্য ইউনিয়নের বিভিন্ন চকসমূহে জলি আমন ধানের চাষ এক সময়ের প্রচলন ছিল। অন্য এলাকায় আউশ ও আমন ধান চাষ হতো। তবে নদী সংলগ্ন এলাকায় কালো বোরো ধান চাষ করা হতো। জলি ধানের এলাকা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য এলাকার চেয়ে নিচু। বরণ জাতের আমন এই এলাকাসমূহে চাষ করতো কৃষকবৃন্দ। বরণ জাতের ধান গভীর পানির ও দীর্ঘ সময়ের, উৎপাদনে ৫-৬ মাস লাগে। আউশ ধান স্বল্পমেয়াদি ২-৩ মাস লাগে, বরণ বাদে ভাওয়াইলা, দিঘা, সাইল জাতের আমন ধানের অগভীর পানির ও ৪/৫ মাসের মেয়াদি ধান। চর ও নদীর পাড় অঞ্চলগুলোতে ঢেপুজাতের আমন উৎপাদিত হতো। সবই আগের দিনের অর্থ্যাৎ বেশি বেশি খাদ্য উৎপাদন কর, সার, কীটনাশক ব্যবহার করো এই শ্লোগান দেওয়ার আগের ঘটনা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে! তাই যে কোনমূল্যে অধিক ফলন লাগবে। তার জন্য উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান, সবজি, বিভিন্ন মৌসুমের শস্য ফসলের বীজ লাগবে। উচ্চ ফলন পেতে হলে ইউরিয়া, টিএসপি, পটাস, জিপসাম, ফুরাডান, বাসডিন, নানান নামের কীটনাশক, ঘাসনাশক জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে চাষের শুরুর হতে কয়েক ধাপে ছিটানো লাগবে।
এখন মাঠে মাঠে কেচলা বরণ, কইজুরি, মধুশাইল, আমশাইল, দুধ ভাওয়াইলা, দিঘা আমন, ষাট্টা, কারোমানিক, পরাংগি আউশ ধানের দেখা যায় না! তার পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল ইরি, বোরো জাতের ধান চাষ হচ্ছে। ধান গবেষণা ধান জাতের চাষের ফলে মাঠ ফসলের বৈচিত্র্যতা কমে যাচ্ছে। বেসরকারি পর্যায় ও কৃষক পর্যায়ে মাঠ ফসলের বৈচিত্র্যতা সংরক্ষণ ও চর্চার নানান কার্যক্রম অনেক স্থানে চালু করার চেষ্টা আছে।
বারসিক মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রামে ধান জাত সংরক্ষণ ও চর্চার কার্যক্রম কৃষক নেতৃত্বে তাদেরকে সহায়তা করার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা, সংরক্ষণ ও সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন হরিরামপুর চর, দৌলতপুর, শিবালয় উপজেলার চর অঞ্চলে কালামানিক ও পরাংগি জাতে আউশ ধান ও হেলাচিয়া, ঘোস্তা, মান্তা, কুন্দরিয়া ভাড়ারিয়ার চকে বোনা ভাওয়াইল্যা ও দিঘা ধানের কয়েকটি জাত অল্প পরিমাণে চাষ করা হয়। ধানে বৈচিত্র্যতা কমে যাওয়ায় মানুষ একই ধরনের ধান দিয়ে মুড়ি, খই, চিড়া, পিঠা ও ভাত খাওয়ার কাজে ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে স্বাদ বা পছন্দের বিষয়টি আর আলোচনার করার সুযোগ নেই।
গত মাসে সহকর্মী সত্যরঞ্জন সাহা নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলায় উয়ারী-বটেশ্বর উন্মুক্ত প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর দেখতে যাই। উয়ারী বটেশ্বর লালমাটির অঞ্চল। গ্রামে ঢোকার সময় জমিতে কালোজিরা ধানের চাষ দেখতে পাই অল্প পরিমাণ জমিতে। মনে মনে ভাবি ফিরতি পথে কৃষকের নিকট থেকে ধান সংগ্রহ করবো। উন্মুক্ত জাদুঘর দেখে ফিরতি পথে কৃষকের বাড়ি খুঁজে কালোজিরা ধানের বীজ কৃষক আব্দুল খালেক ও তার স্ত্রী মিলে আমাদেরকে দেন। কালোজিরা ধান থেকে সুগন্ধি চাল হয়। আমন মৌসুমে এই ধান চাষ হয়। বাংলাদেশের উত্তরাাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় এই ধান চাষ হয়। সুগন্ধি দেশী চাল কালোজিরা ধানের পোলাও চালের চাহিদা আছে ও ভালো দাম পাওয়া যায়। উৎপাদন খরচ কম ও সার কীটনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না, স্বল্পপানির ব্যবস্থাপনা থাকলেই হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে সহকর্মী মুক্তার আলী নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জ থেকে আরেক স্থানীয় সুগন্ধি চাল কাটারীভোগ সংগ্রহ করেছেন। মানিকগঞ্জে কৃষক পর্যায়ে অন্য ধানের সাথে এই ধান দু”টো প্রচলন ও সম্প্রসারণের জন্য আগামী আমন মৌসুমে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কৃষক ও কৃষক সম্প্রতি গড়ে উঠুক-দেশী ধান জাত চাষ ও চর্চা অব্যাহত থাকুক।