পাখিদের বাঁচতে দিন, নিজেরা ভালোভাবে বাঁচুন
ঢাকা থেকে কাজী সুফিয়া আখ্তার
প্রাচীনকাল থেকেই শিশুরা অতি শৈশবে মা-দাদী-নানী-কাকী’র কোলে বসে কথাবলার পূর্বেই নদী-পাখি-ব্যাঙ-ফুল -ফল নিয়ে রচিত ছড়া শুনতে শুনতে বড় হয়। ঘুমোয়। একদিন তাদের মুখে বোল ফোটে। তারাও ছড়া কাটে। ‘আয় রে আয় টিয়ে/ নায়ে ভরা দিয়ে/না’ নিয়ে গেল চিলে…’। আর তারাও নিজের অজান্তে পরিচিত হয়ে ওঠে আমাদের চারপাশে থাকা পাখিদের সঙ্গে। তাদের খাবারের জন্য যেমন উঠোনে খুঁদকুড়ো ছিটায়, ছড়ায়, তেমনি দাদীর সাথে উঠোনের রোদে শুকোতে দেয়া ধানে চড়–ই, শালিক ও কাক তাড়ায়। শৈশবে মায়ের ডাকের আগে আমাদের ভাইবোনদের ঘুম ভাঙতো পাখির কিচিরমিচির শব্দে, ভিন্ন ভিন্ন পাখির কণ্ঠনিঃসৃত সুমধুর ডাকে। আমরা তাদের কলকাকলি খুব উপভোগ করতাম। তবে দোয়েল সবচেয়ে আগে, কিছুটা অন্ধকার থাকতে জানান দিতো রাত পোহানের।
আমাদের মূল বসতঘরের উত্তর পশ্চিম কোণে একটি অসাধারণ সুন্দর বড় ডালপালা ঝাপটানো পুরানো আম গাছ ছিল। তার পাশেই ছিল বাঁশঝাড়, জড়াজড়ি করে একটি গাব গাছ, সটান উঠে যাওয়া সুপারি গাছ। অনেক পাখির বাসা ছিল এখানে। দীর্ঘ বছর অসংখ্য পাখি আম গাছের ডালে পাতার ছায়ায় নিয়মিত দিন ও রাত যাপন করতো। এটাই ছিল তাদের স্থায়ী আবাসস্থল। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাবার আশ্রয়স্থল। শীতের সময় পাখির সংখ্যা বেড়ে যেত। জায়গা নিয়ে ঝগড়াও হত। আমার বেশ মনে আছে, বাঁশ ঝাড়ের মাথায় চারটে বকও সন্ধ্যার পরে এসে আশ্রয় নিত। চড়–ই আমাদের ঘরেই বাসা করে থাকতো টিনের চালের কোণায়। দালান বাড়ির ভেন্টিলেটারে। এখনকার তৈরি বাড়িতে ভেন্টিলেটার থাকে না। চড়–ইও বাসা বাধতে পারে না মানুষের ঘরের মধ্যে। সকাল হলেই উঠোনে জুড়ে কাক, এক পা দুই পা করে জোড় শালিকের হাঁটা দেখে মন ভালো হয়ে যেতো। টুনটুনিও থাকতো বৈকি। ওতো উঠোনের কোণে মায়ের বেগুণ ক্ষেতের বড় পাতার নীচে বাসা বাঁধতো। আমরা বেগুণ ক্ষেতে বেশি সময় লুকোচুরি খেলতে থাকলে মা সাবধান করে দিতেন, এ্যাই টুনটুনির বাসা ভাঙবে না। বহু বছর পরে গত বছর ধানমন্ডির ৯/এ রোডের নাহার আপার পাঁচ তলার ফ্ল্যাট বাড়ির সিড়িঁতে রাখা টবে লাগানো বেগুণ গাছের পাতার আড়ালে একসময়ের খ্যাতনামা অভিনেত্রী রিনি রেজা দেখালো টুনটুনির বাসা। রিনি বলেছিল, আসো, ‘দেখো তোমার ভালো লাগবে।’ সত্যি ভালো লেগেছিল। হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পেলে যেমন আনন্দ হয়, তেমন।
শৈশব থেকেই আমার প্রিয় পাখি। ছোটবেলায়, গ্রামের কৃষকেরা যখন ভাদ্র মাসে জমিতে লাঙল দিয়ে চাষ দিতেন, তাদের পিছনে পিছনে চড়–ই, শালিক উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াতো। মাটির নীচ থেকে উঠে আসা পোকামাকড়, কেঁচো দেখতে পেলেই ঠোঁটে তুলে নিয়ে দে উড়াল। এই দৃশ্যের জন্য এখনও চোখ তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। শিকারি পাখি চিল, ঁেপচা, ঈগল, বাজপাখি বরাবরই কৃষকের ধান নষ্টকারী ইঁদুর খেয়ে কৃষকের উপকার করে। ধানের ক্ষতি করে এমন পতঙ্গভুক পাখি হলো চড়–ই, কাদাখোচা, হুদহুদ, খঞ্জনা, শালিক, গাংশালিক, ঝুটিশালিক, গুইশালিক, নীলকণ্ঠ, ফিঙে, সুইচোরা ও আবাবিল। ফিঙে শুধু পতঙ্গ খায় না, বিষাক্ত পোকামাকড়ের শুককীট খেয়ে কৃষকের উপকার করে। শস্যক্ষেতে পোকামারার রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহারের ফলে আমাদের যেমন জল-মাটির ক্ষতি হয়েছে তেমনি পাখিও অনেক বেঘোরে মৃত্যুবরণ করেছে।
একেক জায়গায় একই পাখির ভিন্ন ভিন্ন নাম। যে ‘বেনেবউ’ সে-ই ‘বউ কথা কও’ পাখি। আবার কোথাও ইষ্টিকুটুম’ বলেও পরিচিত। কত আকৃতি-প্রকৃতি ও বিচিত্র স্বভাবের পাখি ছিল। দোয়েল-কোয়েল-শ্যামা-ফিঙে-ময়না-টিয়া-টুনটুনি-বাজপাখি-চিল-গাংচিল-শকুনÑকবুতর-পাপিয়া-বাবুই-বনটিয়া-বেনেবউ, চড়–ই-কাকাতুয়া-মাছরাঙা-খঞ্জনা-সাত ভায়রা-বউ কথা কও-হলদে পাখি-ময়ূর-ধনেশ-বুলবুলি-ঘুঘু-ফুলঝুরি-মদনটাক-তিতির-সবচেয়ে পরিচিত কাকসহ আরো কত নাম না জানা পাখি। একসময় এই বাংলাদেশে আনুমানিক ৬৫০ প্রজাতির পাখির দেখা মিলতো। তন্মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ ছিল পরিব্রাজক পাখি। বাদবাকি সবই ছিল আবাসিক, আমাদের দেশের পাখি। কোথায় তারা হারিয়ে গেল মানুষের আগ্রাসী লোভের খেসারত দিতে। সকাল-সন্ধ্যায় পাখির ডাকে জেগে ওঠা বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের, গ্রাম ও শহরের সকলের কাক, চড়–ই, শালিক, বুলবুলি, টুনটুনি, দোয়েল, শ্যামা চেনা পাখি। অন্য পাখিদের চেনার উপায় ক্রমেই লোপ পেয়ে যাচ্ছে। কোকিলের মিষ্টি সুর বসন্তে শোনা হোলেও পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই কোকিলকণ্ঠিকে সচরাচর দেখা যায় না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখন আগের মত ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ি পাখি আসে না। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এসে কে বন্দুকের গুলি খেয়ে মরতে চায়! সাথী হারাতে চায়! যদিও বর্তমানে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা, গাছে গাছে হাড়ি বেঁধে দিয়ে পাখিদের বাসা বাধা ও ডিম পারার ব্যবস্থা করা হয়েছে, হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো পাখিবান্ধব গ্রাম হয়েছে। এই ঢাকা শহরেও পাখিবান্ধব বাড়ি আছে। তবু শীতকাল এলেই মনে ভয় জাগে। এবার শীতে আবাসিক, পরিযায়ি কত পাখিবাঁচতে এসে মারা পরবে?
শীতকাল অনেকেরই প্রিয় ঋতু। ঘুরে বেড়ানো এবং সুস্বাদু খাবার খাওয়ার সময়। শীতকাল এলেই বাংলাদেশের মানুষদের পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। কারো কারো সাদা চালের হাতে গড়া রুটি সাথে হাঁসের মাংস ভুনা অথবা পাখির মাংস খুব প্রিয়। এই সময়ে গ্রামাঞ্চলে ও শহরতলিতে খাল-বিল-জলাশয়ে-পুকুরে মাছ ধরার ধুম পরে যায়। মাথার উপরে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় নানা রঙের, নানা আকারের, নানা ডাকের পাখি। এই সময়ে বনে-জঙ্গলে, হাওড়-বিল অঞ্চলের জলাশয়ে প্রচুর পাখি এখনো দেখা যায়। এই সকল অঞ্চলের জেলাগুলোতে এবং বি.বাড়িয়া, সরাইল, খুলনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ জেলাসহ অন্যান্য জেলার হোটেলগুলোতে পাখির মাংস পাওয়া যায়। এই সময়ে পাখি নানা সীমান্ত পথে পাচারও হয়। শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা প্রচন্ড শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মাইল পারি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। আমাদের পাখি শিকারিরা তাদের গুলি করে মেরে খাবার টেবিলে উপাদেয় খাদ্যে পরিণত করেন। কখনো পাচার করে দেন পার্শ্ববর্তী কোন দেশে। তাদের আর স্বদেশে ফিরে যাওয়া হয় না। আমাদের পাখিরাও প্রায়শই তাদের নিজেদের খাদ্য জোগাতে, ছানাদের খাদ্য জোগাতে বাসা থেকে বের হয়ে পাখি শিকারিদের জন্য আর ছানাদের কাছে ফিরে যেতে পারে না। তাছাড়া, বাসার পাশে শালিখ সুপারি বা পেয়ারা কাছে বাসা বাঁধে। ডিম পারে, বাচ্চা ফোটায়। বিড়ালের আগ্রাসী থাবা থেকে তাদের বাঁচানো বড় কষ্টকর। ছানারা উড়তে না শেখা পর্যন্ত মা-পাখি, বাবা-পাখি মিলেই পাহারা দেয়। তবু কখন কখন শেষ রক্ষা হয় না। খাবার আনতে বাসার বাইরে গেলে অনেক সময়ই নিষ্ঠুর অঘটন ঘটে যায়। এটা প্রাকৃতিক। অনিচ্ছায় মেনে নিতে হয়। কিন্তু মানুষ যখন শখের বসে পাখি মারে তখন মেনে নেয়া যায় না। বনের প্রাণী, বনের পাখি রক্ষায় আইন আছে। তবু সুন্দরবনে পাখি কমে যাচ্ছে। আগের মত গাছের মাথায় বড় বড় বকের সারি বাতাসে দুলতে দেখা যায় না।
আসুন, আমরা পাখিদের বাঁচতে দেই। গুলতি দিয়ে, বন্দুক দিয়ে পাখি না মারি। পাখি পাচার না করি। পাখির মাংস না খাই। বনে-জঙ্গলে-জলাশয়ে পাখি অনিন্দ্য সুন্দর পদাবলী রচনা করে। কবি-সাহিত্যিকগণ মুগ্ধ হয়েছেন। শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন। চিত্রগ্রাহকগণ ভীষণ কষ্ট স্বীকার করে তাদের ছবি তোলে তৃপ্তি লাভ করেন। পাখি নিয়ে সকল কালে অজ¯্র ছড়া,কবিতা রচিত হয়েছে। ‘পাখি সব করে রব’ এর অপার্থিব সৌন্দর্য্য,ে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে আসুন আমরাও বাঁচি,বাঁচার প্রয়াস নেই।
ফিচার ইমেজটি সংগৃহীত
লেখক: গবেষক ও নারী নেত্রী