এখানে পানি ব্যবহারে বৈষম্য নেই

বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার

ভূমিকা
জীব জগতে পানির প্রভাব অপরিসীম। পানি ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকত না। এছাড়া মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের অপরিহার্য উপাদান হলো পানি। একজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক মানুষ খাওয়ার কাজে চার থেকে পাঁচ লিটার পানি ব্যবহার করলেও অন্যান্য কাজে অনেক বেশি পানি ব্যবহার করে থাকেন। ভূ-পৃষ্টের প্রায় ৭০.৯ ভাগজুড়ে পানির অস্তিত্ব রয়েছে। পৃথিবীতে এত এত পানি থাকলেও নিরাপদ পানি প্রাপ্যতায় কোটি কোটি মানুষ পিছিয়ে আছে। এই পানি নিয় পৃথিবীতে অনেক বড় বড় ঘটনাও আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাই। পানি বা নিরাপদ পানি একটি বড় আলোচনার বিষয়। পানি কেন্দ্রিক রয়েছে হাজারও প্রকল্প। এই প্রতিবেদনটি মূলত রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার কন্দপুর গ্রামের জনগোষ্ঠীর সর্বজনীন পানি ব্যবহারের ছোট্ট একটি উদাহরণ।

IMG_20190213_163703

পুকুর ও বরেন্দ্র অঞ্চল
রাজশাহী তানোর উপজেলার ভূমি অফিসের তথ্য মতে, এই উপজেলায় ছোট বড় মিলিয়ে মোট ৯৭৮টি খাস পুকুর আছে। যার প্রায় প্রতিটিই বিভিন্নভাবে দখল ও বেদখল হয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এই বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হওয়ার কারণে পুকুরের পানিতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক। আবার পুকুরের পানি ব্যবহারের গ্রামের জনগোষ্ঠীকে বাধা প্রদান করা হয় সময়ে অসময়ে। তবে পানি ব্যবহার করলেও মানুষ আক্রান্ত হয় বিভিন্ন রোগে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগেও এ অঞ্চলের অনেক গ্রামের মানুষই তাদের বিভিন্ন পানিকেন্দ্রিক প্রয়োজন মেটাতে পুকুরের পানি ব্যবহার করতেন। কারণ তখন বর্তমানের মত এত পরিমাণে গভীর নলকূপ, টিউবওয়েল, অগভীর নলকূপ ছিল না। আর এ থেকেই বোঝা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাসের সাথে পুকুরের ইতিহাসও ওতপ্রতভাবে জড়িত। তার প্রমাণ আমরা পাই নাটোরের মহারানী ভবানীর রাজত্বকালীন ইতিহাসে। মহারানী ভবানী তার প্রজাদের পানীয় জলের সমস্যা সমাধানে নিজে ৩৬৫টি পকুর খনন করেছিলেন এবং তার রাজ্য সীমানায় সব স্থানে পানিয় জলের অভাব পূরণে পুকুর খননের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর এ থেকেই ধারণা করা যায়, এ অঞ্চলের অধিকাংশ পুরাতন পুকুরগুলোই সে সময়ে অর্থাৎ আজ থেকে ২৫০-৩০০ বছর আগে খনন করা হয়েছিল।

IMG_20190213_163722

পুকুর ও জনগোষ্ঠীর সম্প্রীতি
উপজেলা সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কন্দপুর গ্রামের অবস্থান। এই গ্রামে সর্বমোট ১১৫টি পরিবারের বসবাস। গ্রামের প্রায় অধিকাংশ মানুষ কৃষির সাথে যুক্ত। এই গ্রামে রয়েছে ৫বিঘার একটি পুকুর। এই পুকুরটিই গ্রামের সকল পরিবারের সদস্যদের এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আলহাজ্ব মো. লফর উদ্দিন সরকার (৮৫) বলেন, ‘১৯৫২ সালের কথা তখন আমাদের গ্রামে ৪৮টি পরিবার ছিল, আমাদের এই দিকে অধিকাংশ জমির মালিক ছিলেন জমিদার শ্রী আষুতোশ বাবু। তিনি ভারতে চলে যাওয়ার সময় আমাদের গ্রামের সদস্যদের পানির চাহিদা পূরণের জন্য বিনামূল্য মালিকানা হস্তান্তর করে দিয়ে যান। সেই থেকে এই পুকুরটি গ্রামের সকলে মিলে সমানভাবে ব্যবহার করছেন।’ গ্রামের আরেক প্রবীণ ব্যক্তি খাজ মোহাম্মদ (৭০) বলেন, ‘আমরা বছরে দুইবার এই পুকুর থেকে মাছ আহরণ করি এবং সব মাছ ৪৮টি ভাগে ভাগ করে দিই। এখন পরিবার বাড়লেও সবাইকে আমরা সমান ভাগে মাছ ভাগ করে দিই। পুকুর বা সমাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবছরই পুকুর থেকে কিছু মাছ বিক্রয় করে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হয়।’ এ বিষয়ে গ্রামের কৃষক মো. রেজাউল ইসলাম (৪৮) বলেন, ‘গ্রামের কোন গরিব পরিবারের মানুষ অসুস্থ বা মেয়ের বিয়ের সময় পুকুর থেকে মাছ বিক্রয় করে টাকা দেওয়া হয়। আমরা এই পুকুরের কোন রাসায়নিক ব্যবহার করি না বলে এই পুকুরের পানি সব সময় ভালো থাকে। গ্রামের সবাই এখানে গোসল, রান্নার কাজসহ দৈনন্দিন কাজে এই পুকুরের পানি ব্যবহার করি।’ পুকুরের পানি ব্যবহার করে নারীরা সারাবছরই মৌসুমী সবজি চাষ করে থাকেন। এ বিষয়ে কন্দপুর গ্রামের কৃষানী মোছা. আনিছা বেগম (৪৫) বলেন, ‘এই পুকুরে সব সময় পানি থাকে বলে আমরা সারাবছরই এই পুকুরের পানি ব্যবহার করে সবজি চাষ করছি। যা আমাদের পরিবারের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।’ এই পুকুরের পানি প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০জন মানুষ গোসল, গবাদি পশু ধোয়ানোসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে বলে গ্রামের অনেক পরিবার সামর্থ থাকলের সাবমারসিবল মটর স্থাপন করেনি যা ভূ-গর্ভস্থ সরক্ষণের ভূমিকা রাখছে। এই পুকুরের পানিতে ৫০ বছর যাবত গোসল করলেও কোন রোগ বা চুলকানি হয়নি বলে স্বীকার করেছেন মো. আবু রাকিব। তিনি বলেন, ‘এই পানি অনেক পাতলা ও কোন গন্ধ নেই তাই ব্যবহার করা নিরাপদ।’

IMG_20190213_163845

গ্রামের একটি পুকুরের পানি ও পুকুর ব্যবস্থাপনা দুটোই যদি নিরাপদ রাখা যায়। তা হলে সেই পুকুর সামাজিক উন্নয়ন, পরিবেশ উন্নয়নসহ গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নেও যে ভূমিকা রাখতে পারে তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো কন্দপুর গ্রামেরর এই পুকুরটি।

happy wheels 2

Comments