পানি ভালো হলে সব ভালো হয়
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
‘আমরা গ্রামের মানুষ নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে আমাদের থাকতে হয়। আর এ সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা তা হলো পানি। এই পানির জন্য নানান ধরনের অসুখ-বিসুখ হচ্ছে। আগে অসুখ ছিলো কিন্তু এখন যেন বেশি নাম না জানা হাজার রকমের অসুখ যেন লেগে আছে। আর এসব গুলোর মূলে রয়েছে পানি, পানি যদি ভালো হতো এবং স্বাস্থ্যসম্মত হতো তাহলে আমরা ভালো থাকতাম। পানি ভালো হলে আমাদের সব ভালো হয়।’
উপরোক্ত এমন কথাগুলো বলেন কাশিমাড়ি ইউনিয়নের কাঠালবাড়ি গ্রামের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সাইফুল ইসলাম। সম্প্রতি বারসিক’র সহায়তায় কাঠালবাড়ি কৃষি নারী সংগঠনের উদ্যোগে কাঠালবাড়ি গ্রামের প্রবীণ কৃষক ছাকাত গাজীর বাড়িতে এলাকার পানীয় জল ও এলাকার পানির পরিস্থিতি উপর লবণাক্ততার প্রভাব বিষয়ক গ্রাম পর্যায়ে আলোচনা সভায় তিনি একথাগুলো বলেন।
আলোচনা সভায় কাঠালবাড়ি গ্রামের কৃষক, কৃষাণী, শিক্ষার্থী, বারসিক’র বিশ^জিৎ মন্ডল ও বিধান মধুসহ মোট ৩৩ জন অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে এলাকার সুপেয় পানির উৎস্য কি কি? উৎসগুলো এলাকা থেকে কত দুরে? পানির সংরক্ষণের পদ্ধতি কি? দিনে ক’বার পানি সংগ্রহ করতে হয়? কাদের সহায়তায় করেন? পানি সংগ্রহে কি রকম খরচ হয়? এরকমই নানান সমস্যা জানার চেষ্টা করা হয়।
সভায় অংশগ্রহনকারীরা বলেন, ‘আমাদের গ্রামের দু’মাথায় দু’টি পুকুর আছে। যা ব্যবহার উপযোগী না হলেও আমরা তা ব্যবহার করি। এছাড়াও আমরা অনেক সময় দুর থেকে পানি সংগ্রহ করি। আবার অনেক পরিবারের পানি ক্রয় করতে হয়। বর্তমান সময়ে আমরা আমরা পুকুরের পানি কোন সময় পিএসএফ ফিল্টার দিয়ে, কোন সময় সরাসরি পুকুর থেকে সংগ্রহ করি, বর্ষার সময়ে বিভিন্ন পাত্রে পানি সংরক্ষণ রাখা, পানি ক্রয় করি ১৫ টাকা ড্রামে দুকলস পানি, এছাড়াও প্রায় ৩কিলোমিটার দুর থেকে পানি সংগ্রহ করে সুপেয় পানির সমস্যা মিটাচ্ছি।’ তারা আরও বলেন, ‘এ পানি সংরক্ষণের জন্য নানান ধরনের উপকরণ ব্যবহার করতে হচ্ছে যেমন মাটির কলস, দস্তার কলস, প্লাস্টিকের ড্রাম, প্লাস্টিকের বোতল, বালতি, ক্যারেট, মাছের পলিথিন, মাটির মেটেতে। এছাড়াও যখন বর্ষাকাল কিংবা যখনই বর্ষা হয় তখনই আমরা বাড়ির যত রকমের উপকরণ আছে সবগুলোতে পানি ভর্তি করে রেখে দিই।’ তারা জানান, সব রকমের পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি বাড়ির নারী, পুরুষ, প্রবীণ, শিশু, প্রতিবন্ধীসহ সবাই মিলে করেন। এছাড়াও কিছু পরিবারে দিনে ২ বার আবার কিছু পরিবার যারা দুর থেকে কিনে নিয়ে আসে তাদের ৫দিন অন্তর অন্তর পানি সংগ্রহ করতে হয়। তাদের এখানে যাদের বড় পরিবার ১০-১২ জনের তাদের মাসে ৯০০ টাকা এবং যাদের ছোট পরিবার ৩-৪ জন তাদের মাসে ৩০০ টাকার পানি ক্রয় করতে হয়।
এই প্রসঙ্গে কৃষাণী আফরোজা বেগম বলেন, ‘আমাদের গ্রামে প্রায় ৩০০ পরিবার আছে। তারা প্রতিনিয়ত পানির এ সমস্যার সন্মূখীন হন। পুকুরের যে পানি খাই তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। পানি যেন দুধ নোনতা। তাও আমরা এই পানি খাই। এছাড়াও গ্রামের অধিকাংশ পুকুরেরর পানি লবণ। লবণ পানির চিংড়ির ঘের তৈরি এবং সম্প্রসারণের কারণে আমাদের এলাকাতে লবণাক্ততা বেশি। যার কারণে একদিকে যেমন সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে বসত বাড়িতে কোন ধরনের ফলজ গাছ ও সবজি চাষ তেমন ভাবে হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধুমাত্র বর্ষার সময় কিছু সবজি চাষ হয়। যখন এলাকাতে লবণ পানির প্রবেশ ছিলো না তখন এলাকার প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে ফলজ গাছ, কাঠ জাতীয় গাছ, বিভিন্ন ধরনের কুড়ানো শাক, বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় মাছ ছিল, গবাদি পশু ছিল পর্যাপ্ত, স্থানীয় ধান চাষও হতো। এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। পানি লবণাক্ততা এবং স্বাস্থ্যসম্মত পানি না থাকার কারণে নানান ধরনের অসুখ হচ্ছে যেমন আমাশয়, ডায়রিয়া, শরীর দুর্বলতা, পেট ব্যথা, কলেরা, এ্যাকজিমা, চুলকানি, দাঁদ সহ নানান ধরনের চর্মরোগ।’
অন্যদিকে প্রবীণ নারী আকলিমা বেগম বলেন, ‘পানির জন্য আমাদের যত হাহাকার। পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণে যেন আমরা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি। বর্ষা হলে কে, কিভাবে পানি সংরক্ষণ করবো সেটা নিয়ে সবার মাথা ব্যথা। সব কিছু নিয়ে যেন ঝাপিয়ে পড়ি যে বর্ষা যদি থেমে যায়। তাই এখন বাজার থেকে ২-৩ টাকা করে নানান ধরনের প্লাস্টিকের বোতল কিনে এনে তাতে পানি ভরে রাখি। আমার ঘরে কমপক্ষে প্রায় ২০০ এর মতো হাফ লিটার, এক লিটার, দুলিটার, পাঁচলিটার এরকম প্লাাস্টিকের বোতল আছে। শুনেছি প্লাস্টিক স্বাস্থ্যসম্মত নয়। তারপর উপায় নেই এভাবে রাখাটা সুবিধা মনে করি। পানি খাই বাঁচার জন্য ভালো থাকার জন্য নয়।’
অংশগ্রহণকারীরা তাদের পানীয় জল ও এলাকার পানির সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেরা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা আরো ভালোভাবে করার জন্য কিছু সুপারিশ ও পরামর্শ প্রদান করেন। সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য সাপ্লাই সিস্টেম, পানি রিফাইন করার কোন পদ্ধতি যাতে লবণের পরিমাণ কমানো যায়। গ্রামের মধ্যকার যেগুলো চুনা নদীর অপরপাশে পুকুরগুলো সংস্কার করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ করা, সাথে কিছু পরিবারকে ট্যাংক সহায়তা করা এবং পানি ব্যববহার সম্পর্র্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।