নিজ বাড়িতেই স্বম্মিলিত কৃষি বাড়ি করে তুলেছেন জলবায়ু সংগ্রামী নারী তারক দাসী
ছন্দা রানী ও শিউলি রানী, (আশাশুনি) সাতক্ষীরা
তারক দাসী (৩১) আশাশুনি সদরের জেলেখালী গ্রামের একজন জলবায়ু যোদ্ধা। ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান ঝড় ও নদীর বাঁধ ভেঙে বাড়ির সম্পদ বলতে যা ছিলো সব শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তার আগে ও পরে আইলা, সিডর, বুলবুল, সেত্রাংসহ অসংখ্য ঝড়ের কারণে নদী বাঁধ ভেঙে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করে চলেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে নিজেদের ভাগ্যের নির্মম পরিবর্তন দেখেছেন তারক দাসী। বার বার ঘুরে দাঁড়াতে চেয়ে আবার সর্বশান্ত হয়েছেন। কিন্তু থেমে থাকেনি তার সংগ্রামী জীবন। ২০২১ সাল থেকে সফল ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত উপকুলের খোলপেটুয়া নদীর পাশে থাকা তার বাড়িতেই ছাগল, হাঁস-মুরগি, কবুতর ও সবজি চাষের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন স্বম্মিলিত কৃষিবাড়ি।
তারক দাসী সাতক্ষীরা আশাশুনি উপজেলার সদর ইউনিয়নের খোলপেটুয়ার নদীর তীরবর্তী জেলেখালী গ্রামের বাসিন্দা। স্বামী, বৃদ্ধ শ^াশুড়ি ও ছোট ছেলেকে নিয়ে চার জনের সংসার তাঁর। বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামী মঙ্গল দাস দিনমজুরের কাজ করেন। অভাবের সংসারে তিন বেলা খাবার না জোটার কারণে মাঝে মাঝে অন্যের মৎস্য ঘেরে শ্যালা বাঁছার কাজ করেন তিনি। কিন্তু এতেও বৃদ্ধ শ^াশুড়ির চিকিৎসা এবং সন্তানের পড়ালেখার খরচ জোটে না। এক প্রকার দিশেহারা এই জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি সঠিক পরিকল্পনা ও অর্থাভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছিলো না।
দিশেহারা জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত তারক দাসীর পরিবারকে ঘুরে দাঁড়া এগিয়ে আসে নেটজ পার্টনারশিপ ফর ডিভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় ও বারসিক’র বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প। ২০২১ সালে জেলেখালী সিএসও এর মাধ্যমে তারক দাসী যুক্ত হোন এই প্রকল্পে। তারপর প্রকল্প থেকে জলযায়ু সহনশীল কৃষিচর্চা, জৈব সার তৈরী, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পান। প্রশিক্ষণ শেষে আয়বর্ধনমূলক সম্পদ হিসেবে প্রকল্প থেকে ১৩,৫০০ টাকা সমমূল্যে ৩টি ছাগল, ৭টি হাঁস-মুরগি ও সবজির বীজ পান। আর এদিয়েই তার বাড়িতে গড়ে তুলেছেন স্বম্মিলিত কৃষিবাড়ি। তারক দাসীর ৩টি ছাগল থেকে বর্তমানে ৯টি ছাগল, ৭টি হাঁস-মুরগি থেকে ২৩টি হাঁস মুরগি হয়েছে। এছাড়া হাঁস ও ডিম বিক্রি করে ৪টি কবুতর ক্রয় করেন সেখান থেকে ১৭টি কবুতর হয়েছে। অন্যদিকে বাড়ির পতিত দেড়শতক জমিতে জৈব পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রকার সবজি চাষ করছেন। ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি-কবুতর পালন ও সবজি চাষের মাধ্যমে নিজ বাড়িতেই তারক দাসী গড়ে তুলেছেন স্বম্মিলিত কৃষি বাড়ি।
তারক দাসী এখন স্বামীর উপার্জনের পাশাপাশি নিজেও আয় করছেন। সবজি বিক্রি, হাঁস-মুরগি ও তার ডিম বিক্রি করে সংসারে সহযোগিতা করছেন। এছাড়া ছাগল, হাঁস-মুরগি ও কবুতর বৃদ্ধি করে এবং সেগুলো বিক্রি করে ঘর নির্মাণ ও গরু ক্রয় করতে চান।
তারক দাসী জানান, নেটজ পার্টনারশীপ ফর ডিভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় ও বারসিক’র বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। এখন তার বাড়িতে যা সম্পদ রয়েছে তার মূল্য অর্ধলক্ষ টাকা। অন্য কোথাও কাজ করতে যেতে হয় না তাঁর। নিজ বাড়িতে ঘরে তোলা স্বম্মিলিত কৃষি খামেরই কাজ করে দিন কেটে যায়। পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলা তারক দাসী পরিবেশ প্রকল্পের সিএসও গ্রুপের সঞ্চয় করে ২০০০ টাকা জমিয়েছেন। এছাড়া পরিবেশ প্রকল্পে কর্মীদের পরামর্শে মাটি তৈরি (লক্ষ¥ী ঘট) দুর্যোগ ব্যাংক এ সঞ্চয় করছেন। সাপ্তাহিক আলোচনায় বিভিন্ন বিষয় জানাসহ মুষ্টি চালের মাধ্যমে খাদ্য ব্যাংক গড়ে তুলেছেন। জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত তারক দাসীর পরিবার আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে জানান এই জলবায়ু যোদ্ধা নারী।
তবে সব সময় আতংকে থাকেন তারক দাসী, আবার কবে আইলা, সিডর, আম্পানের মত ঝড় এসে সব শেষ করে দিয়ে যাবে। তবে এই আতংক একা তারক দাসীর নয়। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত অসংখ্য পরিবারের। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে তারক দাসীদের দাবি তাদের বাড়ির পাশে থাকা নদীতে স্থায়ী বেঁড়িবাধ নির্মাণ করতে হবে।