দুর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বাসন্তি রানীরা

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বন্যা, জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন শ্যামনগর উপজেলার নিত্যসঙ্গী। একটির পর একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলে আঘাত হানছে। নদী ভাঙনের ফলে প্রতিবছর চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রত্যক্ষ প্রভাবটি পড়ছে কৃষির উপর। লবণাক্ত পরিবেশে কৃষিকাজ করে বেঁচে থাকার জন্য উপকূয়লীয় অঞ্চলের কৃষকেরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। বাঁধ ভেঙ্গে লবণ পানি প্রবেশের ফলে কৃষি জমির মাটি ও হয়ে পড়েছে লবণাক্ত। চাষের জন্য মিষ্টি পানির অভাবে কৃষকেরা কৃষি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। এর মাঝেও কেউ কেউ লবণ পানি ও মাটিতে টিকে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এমনই একজন কৃষক শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাটি গ্রামের বাসন্তি রাণী মন্ডল। বাক প্রতিবন্ধী স্বামী পরিতোষ মন্ডলকে নিয়ে মারাত্মক লবণাক্ত মাটি-পানি ও পরিবেশ মোকাবেলা করে পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে তিনি বেড়িবাঁধের রাস্তার ব্লকের ওপর সারাবছর সবজি চাষ করছেন।


এই প্রসঙ্গে বাসন্তি রানী বলেন, “ভেড়িবাঁধের ব্লকের ওপর জ¦ালানির জন্য শুকনো ঘাস এনে গাদা দিয়ে রেখেছিলাম। সেই গাদার ওপর একটি উচ্ছে গাছের চারা বের হলে গাছটিকে যতœ করে ঘিরে রাখি। কিছুদিন পরে সেটাতে ফল ধরা শুরু করলো। তখন অনেক উচ্ছে খেয়েছি। তারপর মনে করলাম ব্লকের উপরে যদি মাটি উঠিয়ে ফসল চাষের উপযোগি করা যায় তাহলে সবজি চাষ করতে পারবো। প্রথমে চর থেকে মাটি উঠিয়ে আইল মতো তৈরি করি এবং মাটির ভিতর ঘরের বেড়ার মতো বিভিন্ন গাছের ডাল সারি সারিভাবে পুঁতে রাখি।’ তিনি বলেন, ‘মাটিতে খুটিপুতে দিলে আর মাটি সরতে পারবে না। মাটি শক্ত হয়ে গেলে ভিতরে নদীর চরের মাটি উঠানো হয়। তারপর মিষ্টি পানির পুকুর থেকে মাটি উঠিয়ে দেওয়া হয়। মাটি প্রস্তুত করার জন্য বাড়ির তরকারীর খোসাপচা সার ব্যবহার করে মাটিতে ফসল চাষযোগ্য করা হয়। বর্তমানে ব্লকের উপর সবজি চাষ করে পরিবারে কিছুটা হলেও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারছি।”


বাসন্তি রানী আরো বলেন, “আমার যখন বিয়ে হয় স্বামীর থাকার কোন জায়গা ছিল না। মামা শ^শুর বাড়ি করার জন্য ৫ শতক জায়গা দিলে সেখানে বাড়ি করে বসবাস করতে থাকি। কিন্তু আইলার সময় বাড়ি ঘর ভেঙে যায় এবং ৫টি ছাগল ছিল সবগুলো মারা যায়। ছোট একটি পুকুর ছিল সেটিও ডুবে সব মাছ চলে যায়। আমি ৮৮ ঝড়, সিডর, আইলা, আমফান, বুলবুল, নার্গিস, ফনী, মহাসেন, আম্পান, সিত্রাং এর মতো ঝড় দেখেছি। কিন্তু আইলার ঝড়ের মতো কোন ঝড় এতো ক্ষতি করেনি। তবে বর্তমানে ঘূর্ণিঝড় বেশি হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ভেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লবণ পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। যার ফলে ঘরের অবকাঠামো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গাছপালা মারা যাচ্ছে। একই জমিতে প্রতিবছর লবণ পানি তুলে চিংড়ী ঘের করার ফলে মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে।’ বাসন্তি রানী জানান, লবণাক্ততা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে চর্মরোগ, ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জ¦র, সর্দি, গলায় ব্যাথা রোগ বেশি হচ্ছে। সুপেয় পানির কোন ব্যবস্থ্যা না থাকায় পাশের্^র বাড়ির টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু দুধ নুনতা যুক্ত পানি খাওয়ার ফলে গায়ে চাকাচাকা চুলকানি উঠছে এবং চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে ছোট একটি পুকুর আছে। পুকুর ছোট এবং আবদ্ধ থাকায় ওই পানিতে স্নান করলে শরীরে ঘা, পাচড়া, চুলকানি বেশি হচ্ছে। যার কারণে গরমের সময় সবাই নদীতে স্নান করে। নদীতে লবণ জল হলেও জোয়ার ভাটার ফলে ওই জলে স্নান করলেও কোন সমস্যা হয় না।”


বাসন্তি রানী বলেন, ‘জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমাদের শরীরের সাথে অনেক কিছু সয়ে গেছে। গরমের সময় বাইরে থেকে আত্মীয়স্বজন আসলেও থাকতে চাই না। অতিরিক্ত তাপ থেকে বাঁচার জন্য আমি ঘরের চাল উচু করে ঘর তৈরি করেছি। আমরা প্রতিনিয়ত বাঁচার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকি। নদী ভাঙনের ফলে প্রচুর উৎপাদনশীল কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এবং নদীর দুই-কূলবর্তী অসংখ্য মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব ভাসমান (জলবায়ু উদ্বাস্তু) মানুষে পরিণত হচ্ছে।’ এই বিরূপ পরিবেশের সাথে ধীরে ধীরে উপকূল অঞ্চলের মানুষেরা নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অভিযোজন করে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

happy wheels 2

Comments