বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুকি মোকাবিলায় যুব সমাজের ভূমিকা
মো.নজরুল ইসলাম: মানিকগঞ্জ
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বর্তমান সময়ে মানব সৃষ্ট কর্মের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউজ গ্যাস বৃদ্ধিজনিত কারণে জলবায়ুগত পবির্তন চরম আকার ধারণ করেছে এবং ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় এই পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অতি কার্বন নিঃসরণ। কার্বন নিঃসরণ হয় মূলত গ্রীনহাউস প্রক্রিয়াকরণ, জীবাশ্ম জ¦ালানি ব্যবহার, শিল্পকারখানার বর্জ্য, রাসায়নিক সার-কীটনাশক কৃষিব্যাবস্থাসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক প্রক্রিয়াকরণের কারণে।
জলবায়ুগত পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব প্রতিফলিত হচ্ছে বন্যা, খরা, ঝড়, অনাবৃষ্টি, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সম্প্রতি মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নির্গমনকেই দায়ী করা হচ্ছে। ১৮০০ সন পরবর্তী শিল্পায়নের বিস্তার লাভের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রাসের নির্গমন পরিমাণ ক্রমেই বেড়েই চলেছে। আমরা জানি, পৃথিবীর চারপাশে ওজন গ্যাসের একটি স্তর রয়েছে এবং ওজোন স্তরে বিদ্যমান ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের সমন্বিত রূপ হচ্ছে ক্লোরোফ্লরো কার্বন (সিএফসি)। মূলত: রেফিজারেটর (ফ্রিজ) এবং তাপানুকুল যন্ত্র (এসি)তে ব্যবহারের জন্য ১৯৩০ সালে দশকে সিএফসি রাসায়নিকসমুহ বাণিজ্যিকভাবে ব্যাবহারের জন্য উদ্ভবিত হয় এবং ফ্রেয়ন নাম দিয়ে পণ্যে উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। এবং পৃথিবীতে অতিরিক্ত ক্লোরোফ্লোরো কার্বন। সিএফসি-র মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ফলে ওজোনস্তরে ছিদ্র তৈরি হচ্ছে। ফলে সূয্য রশ্মি মধ্যে ক্ষতিকারক অতিবেগুণী রশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠে প্রবেশ করছে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্পায়ন পূর্ব সময় থেকে অর্থ্যৎ আঠার শতক থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বায়ুমন্ডলে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ২৮০ থেকে ৩৭৯ পিপিএম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৯০ থেকে ২১০০ সাল পর্যন্ত ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১ দমমিক ৪০ থেকে ৫ দশমিক ৮০ সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। বিশে^র প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ৩০ বছরের মধ্যে হিমালয়ের বরফের পাঁচ ভাগের চারভাগই গলে যেতে পারে। এ সময়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে পারে ০ দশমিক ০৯ থেকে ০ দমমিক ৮৮ মিটার পর্যন্ত। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশে^ ধানের উৎপাদন কমবে আট ভাগ ও গম কমবে ৩২ ভাগ। তাপমাত্রা দেড় থেকে আড়াই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে পথিবীর সমগ্র প্রাণবৈচিত্র্যের এক-তৃতীয়াংশ হুমকির মুখোমুখি হতে পারে বলে জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে। প্রতিবছর বিশে^ যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নিগর্মণ হয় তার প্রায় ৮০ শতাংশই হয় শিল্পোন্নত দেশে। নাইট্রাস অক্সাইড এবং সিএফসি শিল্পোন্নত দেশেই বেশি নির্গমণ হয়। বাংলাদেশে মাথাপিছু কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন মাত্র ১৩৫ কেজি (১৯৯০), যেখানে জাপনে ২.২ টন, আমেরিকাতে ৫.৩ টন এবং সারা দুনিয়াতে গড়ে ১.২ টন।
জলবায়ু পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের জন্য ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের ইন্টার গভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) গঠন করা হয়। ২০০৭ সালের ৬ এপ্রিল আন্তঃসরকার জলবায়ু সংক্রান্ত প্যানেলের চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরই বিশ^বাসীর টনক নড়ে। বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের কোনও প্রভাব পড়বে কি না ত নিয়ে যারা সংশয়ে ছিলেন,তাঁদের কাছেও বিষয়টি গুরুত্ব পেতে শুরু করে। আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুয়ায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পুরো পৃথিবী অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উষ্ণতর হচ্ছে। লাগামহীনভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হওয়ায় এই উষ্ণায়নের মূল কারণ। সুষ্ঠ ও সঠিক প্রশমন বা মোকাবিলা কৌশল না থাকায় আইপিসিসি ভবিষ্যদ্ববাণী করেছে যে, এই শতাব্দীর শেষে বিশে^র তাপমাত্রা ২ থেকে ৪.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে যার ফলশ্রুতিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৮ থেকে ৫৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে উন্নয়নশীর ও অনুন্নত দেশগুলো। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে সাগরের নৈকট্য, অধিক জনসংখ্যা, দরিদ্রতা, হঠাৎ বন্যা, ঘুর্ণিঝড়,জলোচ্ছ্বাস,আঞ্চলিক নদী প্রবাহ প্রণালী,মৌসুমী অতি বৃষ্টি ও শুস্ক মৌসুমে খড়া প্রভৃতি নিয়ামকের ভিত্তিতে প্রাকৃতিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবিত ঝুঁিকপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, আগামী ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৮৮ সেমি. বৃদ্ধি পেতে পারে। তাহলে দেশের উপকূলয়ী অঞ্চলসহ নদীবিধৌতি এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। বিশ^ জলবায় সংক্রান্ত ঝুঁিক ২০০৬ এর মূল্যায়ন অনুযায়ী ১০টি দেশকে সর্বাধিক ঝুঁিকপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এই তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশকে নিয়ে সম্পাদিত সাম্প্রতিকতম গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমান সময়ের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বাড়বে যথাক্রমে ১.০ ও ১.৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস, যা ২১০০ সাল নাগাদ বেড়ে দাঁড়াবে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আরো জানা গেছে, এদেশে শীতের তীব্রতা অনেকটাই কমে যাবে, অথচ গ্রীস্মকালীন গরমের মাত্রা ক্রমশই বেড়ে যাবে। তাছাড়া বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং মাত্রারও পরিবর্তন হবে। ফলে দেশের বৈচিত্র্যময় ছয়টি ঋতুকেও আর আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যাবে না। এই পরিবর্তনের ফলে দেশের বন্যা, আকস্মিক বন্যা, ঝড়, সামুদিক জলোচ্ছাস, অতিবৃষ্টি,অনাবৃষ্টি ও লবণাক্ততা ইতাদির মাত্রা বেড়ে যাবে। উত্তরাঞ্চলে খড়া ও মরুপ্রবণতা দেখা দিবে এবং দক্ষিণাঞ্চলে ঝড় ও সাইক্লোনের প্রকোপ বাড়বে। শুকনো মৌসুমে প্রধান প্রধান নদীর পানি হ্রাস পেতে পারে। নদীর ক্ষীণ প্রবাহের কারণে সামুদ্রিক লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নদ-নদীর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। সামুদ্রিক লোনা পানি অধিকতর উজানে প্রবেশ করায় কৃষিতে সেচের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাদু পনির অভাব দেখা দিবে। এছাড়া মৎস্য সম্পদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। উপকূলীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে ও এলাকায় ব্যপক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রতিকৃল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে দেশের সর্বত্র এবং সব মৌসুমে ফসলের ফলন কমবে। সবচেয়ে বেশি ফলন কমবে গমের, এরপর আউশ ধানের। আদ্র ও অধিকতর গরম আবহাওয়ার জন্য ফসলের খেতে পোকা মাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যাবে। ভারী বর্ষণের ফরে নি¤œাঞ্চলে সৃষ্টি হবে দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতা। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ভবদহ,তালা এখন অত্র এলাকার বড় সমস্যা। জলাবদ্ধতা নিরসনে এ পর্যন্ত বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। দু’একবছর কিছুটা পানি নিস্কাষণ হলেও পরে একই সমস্য আবার দেখা দেয়।
মানিকগঞ্জের পরিবেশ ও প্রতিবেশগত সমস্যা
বর্তমান সময়ে প্রাকৃতিক দুর্য়োগে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির জন্য একপাক্ষিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই এই ক্ষয়ক্ষতির সাথে স্থানীয় প্রতিবেশগত পরিবর্তনের সম্পর্ক নিরূপন করা হচ্ছে না। আমাদের দেশে নানাভাবে নিজেরাই আমরা আমাদের পরিবেশকে প্রতিনিয়ত সংকটাপূর্ণ করছি। বাঁধ ভেঙে লবণ পানি ঢুকলেও তার দোষ ঢালাওয়াভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাঁধ নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতাকে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার নেয়ার জন্য কেউ থাকে না। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের ভিতরে মোট ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চল রয়েছে এবং প্রতিটি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট রয়েছে। তাই কোন একক পরিকল্পনা দ্বারা এই ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলে সমানভাবে এবং একই সূচকের মাধ্যমে দৃশ্যমান হবে না।
মানিকগঞ্জ জেলার পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। তারমধ্যে নদীভরাট, শিল্প দূষণ, নদী ভাঙ্গন, অপরিকল্পিত রাস্তা-বাঁধ ও সেতু নির্মাণ, আর্সেনিক সমস্যা অন্যতম। এই সকল সমস্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্থানীয় এলাকার প্রাণবৈচিত্র্যর উপর ক্রমবর্ধনশীল ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে এবং স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত ভঙ্গুর পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রয়োজন কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা, যা স্থানীয় মানুষের অবিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, চাহিদা ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের জ্ঞানের সমন্বয়ে তৈরি হবে। পরিকল্পনায় শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তন নয় এরসাথে স্থানীয় প্রতিবেশগত পরিবর্তনের সম্পর্ক নিরূপন করে উদ্যোগ নিতে হবে। তারপরও নি¤েœ প্রধান কয়েকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করা হলো:-
নদী ভরাট
আমাদের মানিকগঞ্জ জেলা একটি নদী বিধৌতি মধ্য সমতল প্লাবন ভূমি অঞ্চল। মানিকগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা, যমুনা, ধলেশ^রী, ইছামতি, গাজীখালি, ক্ষিরাই, মন্দা, নুরানীগঙ্গা, কান্তাবতী, ভূবনেশ^র ও কালিগঙ্গা প্রভৃতি নদ নদীর মধ্যে বর্তমানে ধলেশ^রী, ক্ষিরাই, ভূবনেশ^র, নুরানীগঙ্গা ও মান্দা নদী নাব্যতা হারিয়ে সমতল ভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং কিছু অংশে ক্ষীণ জলধারা জীবিত আছে। আশার কথা হলো মানিকগঞ্জে স্থানীয়ভাবে ধলেশ^রী নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি ও বেসরকারি সংগঠন বারসিক এর নানামুখী তৎতপরতায় বর্তমান সরকারের নদী শাসন প্রকল্পের অংশ হিসেবে গত বছর ধলেশ^রী নদীর একাংশ ৪৫ কি.মি খনন করা হয়েছে। অন্যন্য নদীগুলো খনন করে সারাবছর পানি প্রবাহের জন্য বেসরকারি সংগঠন বারসিক স্থানীয় সংগঠনের সাথে যৌথভাবে কর্মসুচি পালন করে আসছে।
বর্তমানে স্থানীয় এসব নদীতে যতটুক পানি আছে তাও দূষিত। তাই ওই পানির স্পর্শে শরীর চুলকায় ও ঘা হয়। গরু, ছাগল গোসল করালেও গরুর শরীরে ঘা দেখা যায়। এই পানি পারিবারিক কোন কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এরফলে শুস্ক মৌসুমে স্থানীয় এলাকায় পানির হাহাকার পরে যায়। অন্যদিকে স্থানীয় পুকুরগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করাতে সেখানে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার, মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে এসকল পুকুরে গোসল করলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের খোসপাচড়াসহ নানা রোগ-ব্যাধি দেখা দিচ্ছে। এছাড়া টিউবয়েলের পানিতে ক্ষতিকর আইরন আর্সেনিক তো আছেই। নদীতে পানি না থাকার কারণে এলাকায় কৃষক একখন্ড জমিতে বছরে তিনটি ফসল চাষ করতে পারছে না। পরিবর্তিত কৃষিপ্রতিবেশে স্থনীয় বহু সংখ্যক কৃষক ঐতিহ্যগত ফসল চাষের পরিবর্তে ভূট্টা, তামাক বা অন্যন্য অর্থকরী ফসলের চাষাবাদ করছে। দেশীয় জাতের বিন্নি ফসল আবাদ না হওয়ার ফলে এলাকায় গো-খাদ্য ও জ¦ালানি সংকট দেখা দিচ্ছে। জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে পেশাগত পরিবর্তন ঘটছে।
নদীতে পানি না থাকার ফলে শামুক, ঝিনুক এবং দেশী জাতের বিভিন্ন মাছ যেমন-কাউনিয়া, দেশী স্বরপুটি, এলাং, ফেশা, চিতল, বেতরাঙা, তাপসী, পাথরচুনা, কই, রয়না ইত্যাদি বিলুপ্ত প্রায়। হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন লোক সংস্কৃতি যেমন- নৌকা বাইচ, ভেউরা ভাসানো, গাজীর গান, গুরকুনাথের সিন্নী, গাওইলা সিন্নি ইত্যাদি। স্থানীয় মানুষের মতে, যমুনা সেতু তৈরি হওয়ার পর থেকে যমুনা সেতুর ভাটি অঞ্চলে চর জেগে ওঠায় এ অঞ্চলে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে আশির দশকের শুরুর দিকে ফ্লাড একশন প্ল্যান (ফ্যাপ) এর আওতায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পানির স্বাবাভিক প্রবাহকে বন্ধ করে দেয় এবং ধলেশ^রী মৃত নদীতে পরিণত হতে থাকে।
এছাড়াও পলি পড়ে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার ফরে স্বল্প বর্ষাতে স্থানীয় এলাকায় বন্যার রূপ ধারণ করে। পূর্বে এই এলাকায় আমন ধান, আউশ ধান,কাঁচা মরিচ,পেঁপে বেশি আবাদ হতো। বর্তমানে এলাকায় পানির স্বল্পতার কারণে ইরি, ভুট্টা, পেঁয়াজ, তামাক চাষাবাদ হচ্ছে। কেননা এসব শস্য চাষাবাদ করার জন্য বেশি পানির প্রয়োজন হয় না। এবং সামান্য পানির প্রয়োজন হলে সেচ ব্যবহার করা যায়। উপরোক্ত সমস্য সমাধানের সহজ কোন পথ না থাকলেও কৃষক তাঁর প্রয়োজনে প্রাকৃতিক উৎসের অভাবে ভুগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করছে তথা সেচের উপর নির্ভরতা করে কৃষি কাজ পরিচালনা করছে। যেটি পরবর্তীতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁিক আরো বৃদ্ধি করবে।
শিল্প দূষণ
এই সময়ে মানিকগঞ্জের উপর দিয়ে প্রবাহিত অন্যন্য নদীর মতোন কালীগঙ্গা নদীও পলি পরে ভরাট হয়ে যাওয়ায় মৃত প্রায় রূপ নিচ্ছে। অন্যদিকে নদীতে যতটুক পানি আছে তাও পাশ^বর্তী শিল্প কারখানার বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। শিল্প কারখানার দূষিত বর্জ্যে কালিগঙ্গা নদীর মাছ এবং জলজ প্রাণী প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। এবং মাছের প্রয়োজনীয় প্রজনন পরিবেশ না থাকার ফলে কালীগঙ্গা নদী মাছশুন্য হয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় অধিবাসীদের ধারণা। শুস্ক মৌসুযমে এই নদীর পানি দুষিত হলেও তাই স্থানীয় মানুষ পানির অন্য কোন উৎস না থাকায় বাধ্য হয়ে গোসল, গরু ঝাপানোসহ বিভিন্ন ধরনের গৃহস্থালী কাজে এই নদীর দূষিত পানি মানুষ ব্যবহার করছেন। এতে করে চর্মরোগ, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এলাকার সাধারণ জনগণ। অথচ কারখানায় বাধ্যতামূলক (ইটিপি) থাকার কথা থাকলেও অনেক কারখানায় ইটিপি নেই কিংবা অধিকাশ সময়ই বন্ধ করে রাখা হয়। অপরদিকে কিছু কোম্পানি ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের শিল্পবর্জ্য কালিগঙ্গা নদীতে ফেলার কারণে পানি দুষিত হচ্ছে। আবার কিছু বর্জ্য (কাঠের গুড়া) বাতাসের সাথে মিশে ফ্যাক্টরির পাশ^বর্তী এলাকার বায়ু দূষিত করছে এবং স্থানীয় মানুষের স্বাস-প্রশ^াসে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অনেক অভিযোগ আছে। এছাড়াও এই ধরনের শিল্প কারখানা তৈরি করায় কালিগঙ্গা নদীর কিছু অংশ দখল হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।
নদী ভাঙন
নদী ভাঙন মানিকগঞ্জের আরেকটি পরিবেশগত সমস্যা। নদী ভাঙনে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর, ঘিওর, শিবালয় ও দৌলতপুর উপজেরঅর বেশ কিছু বসত এলাকা ও আবাদী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক নিয়মে নদী তীর ভাঙলেও অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ নির্মাণ ও অপরিকল্পিত ড্রেজিং ব্যবসায়ীদের কারনে নদী ভাঙনের গতি আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। নদী ভাঙনের ফলে ভাঙন প্রবণ এলাকা থেকে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের মানুষ ক্রমশই নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরমূখী হচ্ছে এবং আর্থিকভাবে প্রান্তিক পরিবারগুলো ভূমিহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এছাড়াও বহুসংখ্যক কৃষিনির্ভর পরিবার নিজস্ব কৃষিজমি হারিয়ে প্রান্তিক কৃষক বা দিনমজুরে পরিণত হয়েছে। নদী ভাঙনের ফলে কৃষিবৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে, ফলে সামগ্রিকভাবে জেলার কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার ফলে কেবল পরিবারভিত্তিক আর্থিক ক্ষতিই হয়নি বরং জাতীয় অর্থনীতির খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। এছাড়াও স্থানীয় এলাকায় পেশাগত পরিবর্তন আসছে। উদাহারণস্বরূপ বলা যায় যে, প্রান্তিক কৃষক পরিবারগুলো ভূমিহীন দিনমজুর পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে স্থানীয় অন্যান্য এলাকায় নদী ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো নতুন করে কোন এলাকায় বসতি স্থাপন করছে। ফলে ওই এলাকায় জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষি জমির পরিমাণ আরো হ্রাস পাচ্ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে স্থানীয় এলাকার পরিবেশ বহুমাত্রিকভাবে দূষিত হচ্ছে এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য অবস্থান বজায় থাকছে না।
অপরিকল্পিত রাস্তা-বাধ ও সেতু নির্মাণ
পাকিস্তান আমলে ১৯৬৩ সালে জাগির ব্রীজ নির্মাণের সময় এই এলাকায় তিনটি বাঁধ দেয়া হয়। প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্রীজ তৈরি শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাঁধ তিনটি অপসারণ করার নিয়ম থাকলেও অদ্যাবধি তার বাস্তবায়িত না হওয়ায় ধীরে ধীরে নদীতে চর পড়তে থাকে। অতীতে ধলেশ^রী নদীর পানি মেঘশিমুল এলাকায় কৃষি কাজে সেচের মুল উৎস ছিল। তখন স্থানীয় এলাকার অধিকাংশ জমিতে প্রতিবছর তিন মৌসুমে আউশ আমন আর বোরো ধান চাষ করা হত। বর্তমানে আমন আর বোরো ধান চাষ হয়। প্রয়োজনীয় পানির অভাবে কোন কোন জায়গায় শুধুমাত্র বোরো ধান চাষ করা হয়। এখন কৃষিকাজ সচল রাখার জন্য মাটির নীচ থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচের দিকে যাচ্ছে। এতে করে আর্সেনিক সমস্যা দিন দিন বাড়ছে বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে অতীত প্রচলন না থাকলেও কৃষি উৎপাদনে সেচ হিসেবে পানি সরবারহের জন্য একজন কৃষককে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যুব সমাজের ভূমিকা
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল নতুন প্রজন্মকেই সবচেয়ে বেশি বহন করতে হবে। স্থানীয় এলাকায় প্রতিবেশগত যে নেতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে তার সাথে যদি জলবায়ুগত পরিবর্তন যুক্ত হয় তাহলে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হবে এবং সেই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া কোন সহজতর কাজ নয়। তাই সামগ্রিকভাবে পরিবেশ প্রতিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা বাংলাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, দেশের কোন সংকটকালীন মুহুর্তে দেশকে রক্ষা করতে যুব সমাজ সবসময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আমরা আশা করছি বিরাজমান সমস্যা সমাধানে দেশের যুব সমাজ ব্যক্তি ও সামষ্টিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ইতিমধ্যে ব্যক্তি, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চলছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৃহৎ সমস্যার বিপরীতে যেসব উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে, সেগুলো খুবই সামান্য।
স্থানীয় জলবায়ু, পরিবেশ ও প্রতিবেশগত নেতিবাচক পরিবর্তন রোধে ও সমস্যা নিরসনে যুব সমাজের ভূমিকা রাখতে হলে প্রথমেই যে বিষয়টি দরকার সেটি হলো- যুব সমাজকে চলমান সামগ্রিক জীবনযাত্রার কার্যক্ষেত্রে বহুমাত্রিক অভ্যাসগত, আচরণগত ও মানসিক পরিবর্তন আনতে হবে, সেই সাথে আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে যেকোন ধরনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিধ্বংসী কাজে নিজেকে ও অন্যকে বিরত রাখতে অনুরোধমূলক প্রচারণা করতে হবে এবং প্রয়োজনে সমষ্টিগতভাবে আন্দোলন করতে হবে। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের লেখনি ও পোর্টাল মাধ্যম পাঠ, সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ, পত্রিকা পাঠ ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া থেকে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজে সচেতন হতে পারেন, অন্যদিকে নিজ নিজ অঞ্চলের মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারেন। পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখতে প্রাকৃতিক বন রক্ষার পাশাপাশি তরুণ সমাজ এলাকার পরিবেশ উপযোগী দেশীয় ফলজ ও দেশীয় বনজ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পরিচালনা করার মাধ্যমে স্থানয়ি জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য অঞ্চলভিত্তিক যে সকল লোকায়ত জ্ঞান ও অভিযোজন কৌশল রয়েছে যুবসমাজ নিজ অঞ্চলে সেই জ্ঞানকে পরিচিত করে তুলতে পারে। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বিশেষ করে বিজ্ঞান ও কৃষি শিক্ষক, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা, ইউপি) স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সরকারি (ক্লাইমেট চেঞ্জসেল, পরিবেশ অধিদপ্তর, (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বুরো)ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, সমাজকর্মী, সাংস্কৃকর্মী ও সংগঠন, গণমাধ্যমের সাথে অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে একসাথে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও প্রয়োজনে প্রায়োগিক কাজ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। আমরা আশা করি দেশের যুব সমাজ রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্থানীয় জলবায়ু পরিবেশ ও প্রতিবেশগত নেতিবাচক পরিবর্তন রোধ ও সমস্যা নিরসনে চলমান কর্মকান্ডে ব্যক্তিগত উদ্যেগে ও সামষ্ঠিগতভবে এগিয়ে আসবে।
বিশ্ব এখন নজিরবিহীন ও চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। আর এই দুর্যোগ বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের মধ্য সমতল ভূমির জেলা হিসেবে মানিকগঞ্জ তার বাইরে নয়। প্রতিবছর বিশে^র নির্দিষ্ট কোন দেশে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন, যা কনফারেন্ষ অফ পার্টিস নামে পরিচিত। এই ধরনের সম্মেলনে আমরা আশা করি বিশ^নেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলায় কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমনের হার কমানোর ব্যাপারে একমত হবেন এবং বাংলাদেশসহ অন্যন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু ন্যায্যতার আলোকে ক্ষতি পূরণ দানের যে দাবি উঠছে তার প্রতি সম্মান দেখাবেন। পাশাপাশি আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম যৌক্তিক দাবিনামা ও আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে জলবায়ু ও জেন্ডার ন্যয্যতার আন্দোলনকে বেগবান করবে।