গুল: ব্যয় সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব জ্বালানি
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
গ্রামীণ নারীরা লোকায়ত জ্ঞান, প্রযুক্তি ও চর্চার মাধ্যমে পারিবারিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। দেশের উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলায় নানা ধরনের লোকায়ত চর্চা লক্ষ্য করা যায়। নারীর বিভিন্ন লোকায়ত জ্ঞান ও চর্চার মধ্যে জৈব জ্বালানি ‘গুল’ একটি উল্লেখ্যযোগ্য চর্চা। উপকূলীয় জনপদের গ্রামীণ অনেক পরিবার এই গুল জ্বালানি ব্যবহার করেন। গুল হল এক ধরনের জ্বালানি। যেটা গ্রামীণ নারীর একটি লোকজ চর্চা। দেশের উপকুলীয় অঞ্চলে গুল তৈরির প্রচলন শুরু হয় প্রায় সত্তরের দশকে। উপকুলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ শুরু হলে এ গুল জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি হতে থাকে। বিশেষ করে ২৫ মে ২০০৯ সালের আইলার পর থেকে এ অঞ্চলের গুলের ব্যবহার বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। চিংড়ি চাষের প্রসার এবং আইলা পরবর্তীতে এ এলাকায় গাছপালা কমে যায়। ফলে কাঠের অভাব দেখা দেয়। এজন্য বিকল্প জ্বালানি হিসেবে গ্রামের মানুষ গুল ব্যবহার করতে থাকেন। প্রথম দিকে গ্রামের কম পরিবার এটার ব্যবহার করত কিন্তু পরবর্তীতে এটার ব্যবহার লাভজনক ও পরিবেশ বান্ধব হওয়াতে অনেক পরিবার ব্যবহার বৃদ্ধি করে।
গুল তৈরির প্রধান উপকরণ কয়লা ও কাদামাটি। জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারে পর অবশিষ্ট ছাই থেকে কয়লা তৈরি করা হয়। কয়লা ভালোভাবে গুড়া (পরিমাণমত টুকরা একেবারে মিহি না, তেতুল বীজের মতো) করতে হয়। এরপর এই কয়লার সাথে নরম মাটি (পুকুরের পচা কাদা) মিশিয়ে গোল পাকিয়ে রোদে শুকিয়ে এই গুল তৈরি করা হয়। প্রায় এক কেজি কয়লার সাথে প্রায় ২৫০ গ্রাম কাদামাটি মিশিয়ে গুল তৈরি করতে হয়। তৈরির পর তিন/চার দিন রোদে শুকানোর পরে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
এই গুল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের সুবিধা অনেক। গুল জ্বালানি বিভিন্ন সময়ে গ্রামীণ নারীদের সাথে একক ও দলীয় আলোচনা ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে জ্বালানি হিসেবে গুল এর প্রয়োজনীয়তার বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। বর্তমান সময়ে উপকূলীয় শ্যামনগর এলাকায় জ্বালানি হিসেবে গুল বেশ পরিচিত। এ জ্বালানি উৎপাদন খরচ একবারে সীমিত। যেসকল পরিবার কয়লা সংগ্রহ তথা উৎপাদন করে সে সকল পরিবারে গুল তৈরিতে নিজেদের সাময়িক পরিশ্রম ছাড়া অন্য কোন খরচ হয় না। জ্বালানি কাঠের অভাবে গুল বেশি ব্যবহৃত হয়। এটা ব্যবহারের ফলে জ্বালানি কাঠের উপর চাপ কমছে একই সাথে অপচয় রোধ হচ্ছে। এটা ব্যবহারকারী প্রতিটি পরিবারে জ্বালানি খরচ কমে, আর্থিক আয় বৃদ্ধি পায়।
বায়োমাস জ্বালানির মতোই গুল উপকূলীয় জনপদের গ্রামীণ পরিবারে একটি বিশেষ জ্বালানি বিবেচিত হচ্ছে। তবে এই গুল জ্বালানি সাধারণ চুলায় ব্যবহার করা যায় না। এক্ষেত্রে জ্বালানি সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহার করতে হয়। মূলত গুল ব্যবহারের জন্য চুলায় এক ধরনের লোহার চাকতি ব্যবহার করা হয়, যাতে করে চুলার নিচের অংশ কিছুটা ফাঁকা থাকে। গুল জ্বালানি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা ও পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। কেননা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য অধিকাংশ পরিবারের গ্রামীণ নারী রান্নার উপকরণ হিসেবে গুল ব্যবহার করছেন। গুল ব্যবহার করার ফলে গাছপালার উপর কিছুটা হলেও চাপ কমছে। গুল ব্যবহারের ফলে জ্বালানি কাঠের ব্যবহার কমে গেছে। গুল জ্বালানি ব্যবহারের ফলে হাড়ি পাতিলে কালি পড়ে না, ঘরের মধ্যে ধোঁয়া একবারেই সামান্য পরিমাণে হয়। এজন্য এ জ্বালানি নারী ও শিশুবান্ধব।
এছাড়া জ্বালানি হিসেবে গুলের ব্যবহারে ব্যয়ের পরিমাণ কম হয়। গুল সম্পর্কে কৌশল্যা মুন্ডা, বিনোদিনী মুন্ডা বলেন ,“গুল বানাতে কোন খরচ হয় না। কাঠ জ্বালানোর পরে সাথে সাথে তুলে পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেললে সেটা কয়লা হয়। আর এই কয়লার সাথে পুকুরের পঁচা নরম মাটি/কাদা একসাথে মিশিয়ে সেটাকে গোল পাকিয়ে শুকাতে হয়। শুকিয়ে গেলে এটা রান্নার জ্বালানি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটার জ্বালানো শেষে অবশিষ্ট চাই দিয়ে বাড়ির হাড়ি, কড়া ও থালা-বাসন মাজা যায়”। জ্বালানি হিসেবে গুল এর ব্যবহার এ বিষয়ে জাতীয় পরিবেশ পদক ২০১৫ এর সম্মাননা স্মারক প্রাপ্ত ময়না রাণীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের জ্বালানি দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। আমাদের যেটুকু জ্বালানি আছে তার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। আমাদের পরিবার ও পরিবেশ বাঁচবার জন্য গুল ব্যবহার বাড়াতে হবে। এটা ব্যবহারে হাড়ি পাতিলে কোন কালি পড়েনা এবং ধোয়া হয় না। তিনি আরও বলেন, “আমি যে পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরি করি তাতে সব রকম জ্বালানি উপকরণ বিশেষ করে গুল ব্যবহার করা যায়। এজন্য জ্বালানি সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহার ও গুল ব্যবহার করতে হবে। তাহলে আমাদের পরিবেশের জন্য ভালো হবে।”
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদের গ্রামীণ পরিবারের জন্য গুল জ্বালানি একটি পরিবেশবান্ধব টেকসই জ্বালানি হিসেবে বিবেচিত। পরিবেশ সুরক্ষা, পারিবারিক ব্যয়সংকোচন ও সুষ্ঠু জ্বালানি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে গুল জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা জরুরি। এজন্য প্রয়োজন সাধারণ মানুষকে সচেতন, উদ্বুদ্ধ ও কৌশলী করে গড়ে তোলা, সেক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারী সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন।