ওদের একটি সুন্দর পরিবেশ দিই
সিলভানুস লামিন
প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করি। আমিও। কখনও বাসা থেকে অফিস, অফিস থেকে বাসা, কখনও গ্রামের বাড়িতে, কখনওবা অফিসের কোন কাজে। এই যাত্রাটা কখনওবা হেটে কখনওবা যন্ত্রযান ব্যবহার করে। যন্ত্রযানে যাত্রাকালে নানান মানুষের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। কারও সাথে শুধুমাত্র সেকেন্ডের ভগ্নাংশে (দু’টি গাড়ি, ট্রেন বা বাস যখন পরস্পরকে ক্রস করে তখন জানালার পাশে বসে থাকা অনেক মানুষের সাথে চোখাচোখি হয়।) দেখা হয়। হয়তোবা জীবনে আর কোনদিনও তাদের সাথে দেখা নাও হতে পারে! কারও সাথে আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখা হয় (এই যানবাহনে যাত্রাকালে); কারও সাথে আলাপও হয় মাঝেসাঝে।
তবে আমি প্রতিদিন এই যন্ত্রযান কিংবা হেটে যাত্রাকালে বাইরে কর্মরত বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণীর মানুষকে লক্ষ্য করি! তবে আমার এই নিবদ্ধ দৃষ্টি থাকে শিশুদের ওপরই বেশি। হয়তোবা আমি দু’জন শিশুর বাবা বলেই শিশুদের প্রতি আমার আলাদা দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এভাবে আমি প্রতিদিন লক্ষ্য করি অনেক শিশুকে। তারা কেউ বসতিতে খেলছে, খোলা মাঠে ঘুরছে, কেউ ঝগড়া করছে, দুষ্টুমি করছে, কাঁদছে। কেউ পিতা বা মাতাকে সহযোগিতা করছে কাজে। কেউ কেউ নদী, পুকুরের পানিতে লম্ফজম্ফ করছে, কেউবা নতুন খেলনা নিয়ে গবেষণা করছে, কেউ কাগজ দিয়ে, কাঠ দিয়ে কেউ মাটি দিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন জিনিস, কেউ গরু, ছাগল, মহিষ চড়াচ্ছে খোলা মাঠে। কারও কারিগরি জ্ঞান দেখে অবাক হই! কারও কান্না দেখে মায়া হয়! অন্যদিকে কাউকে আবার দেখি গাড়ির কন্ডাক্টরের কাজ করতে, যাত্রীর কাছে সুন্দর কৌশলে ভাড়া আদায় করছে, কেউ ইটভাটা, কারখানায় কাজ করছে, কেউবা হোটেল ও রেস্তুরেন্টে কাজ করছে।
আমি লক্ষ্য করি প্রতিটি শিশুরই আলাদা প্রতিভা, মেধা ও দক্ষতা রয়েছে। যে শিশুটি লেগুনার কন্ডাক্টরের কাজ করছে সে কি সুন্দর কৌশলে যাত্রীদের সেবা করছে, ভাড়া আদায় করছে! কোন কোন শিশুকে দেখি অলিগলি কিংবা মফশল শহরের বিভিন্ন হোটেল ও রেস্তুরেন্টে সুচারুরূপে কাজ করতে! ওদের বয়স কতইবা হবে? বড়জোর ৯ থেকে ১০ বছর! আমার ছেলের বয়সী! কিন্তু জীবিকার সন্ধানে তাদেরকে এই বয়স থেকেই সংগ্রাম করতে শিখতে হচ্ছে। এ কাজ করতে গিয়ে ওদেরকে হয়তো অনেকে বকাঝকা করছেন, গালি দিচ্ছেন কিংবা আদর করছেন, কেউবা প্রতারণা করার চেষ্টাও করছেন! এ বয়স থেকেই জীবনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়ের সাথে ওদের পরিচয় ঘটছে। আমি চিন্তা করি, আমার ছেলেকে কী আমি এই অবস্থায় দেখতে চাইবো? অবশ্যই নয়। আমি শুধু কেন? কোন অভিভাবকই চাইবেন না তাঁর সন্তান এই অল্প বয়সেই এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করুক। ওই শিশুর জায়গায় নিজের সন্তানকে কল্পনা করতেই দেখি আমার ভেতরটা হু হু করে কাঁদছে, বুকটা কেমন জানি মোচর দিয়ে উঠছে!
পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই আলাদা প্রতিভা, মেধা ও বুদ্ধি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। তাই তো সব মানুষই একই ধরনের কাজ করে না, একই ধরনের কাজ করতে পারে না! প্রতিটি মানুষই অনন্য, প্রতিটি মানুষই আলাদা! তাই তো কেউ ভালো গাইতে পারে, কেউ আঁকতে পারে, কেউবা আবার ভালো লিখতে ও বলতে পারে। কেউ নতুন কিছু তৈরি করতে পারে, কেউ চিকিৎসক হয়, কেউ প্রকৌশলী, কেউ আইনজীবী, সাংবাদিক হয়। কেউবা আবার দার্শনিক হয়, বিজ্ঞানী হয়। এভাবে মানুষের ভেতরে এই ‘অনন্য’ বৈশিষ্ট্যের কারণে পৃথিবীতেও নানান ধরনের পেশা, কাজ ও সৃষ্টি তৈরি হয়েছে। তবে বলে রাখা ভালো, শিশু অবস্থায় কোন শিশুর যে গুণ ও প্রতিভা দেখা দেয় সেই গুণ বা প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে সেটি সঠিকভাবে প্রষ্ফুটিত হয় না, বিকাশ হয় না।
সমাজবিজ্ঞানীগণ শিশুদের সামাজিকীকরণের ওপর অনেক জোর দিয়েছেন। তাঁদের মতে, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় শিশুরা যেসব পরিবেশে বেড়ে উঠে সেটাই প্রতিফলিত হয় তাদের পরবর্তী জীবনে। অর্থ্যাৎ কোন শিশু যদি নেতিবাচক পরিবেশের বেড়ে ওঠে তার মানসপটটাও নেতিবাচকতায় পরিপূর্ণ হয়। সে যদি সহিংস পরিবেশে বেড়ে ওঠে পরবর্তীতে তাঁর আচরণ অনেকক্ষেত্রে সহিংস হয়। অন্যদিকে কোন শিশু যদি ইতিবাচক পরিবেশে বেড়ে ওঠে পরবর্তীতে সে ইতিবাচক হয়, সে আশাবাদী হয়। সমাজবিজ্ঞানী ডারখেইম যর্থাথই বলেছেন, ‘শিশুদের মন সাদা কাগজের মতো’! যে রঙের কালি দিয়ে লেখা হবে এই সাদাকাগজে সেই রঙটির আঁচর দেখা দেবে। সমাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় শিশুরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে সেটাই প্রতিফলিত হবে তাদের জীবনে।
এবার চিন্তা করি শুধু ঢাকার কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও কিংবা ঢাকার অন্যান্য বস্তিতে বসবাস করা শিশুদের কথা! কী পরিবেশে বেড়ে উঠেছে তারা? এসব বস্তির শিশুদের মধ্যে হয়তোবা এমন শিশুরাও রয়েছে যারা নাকি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, নিউটন, চিত্রশিল্পী পিকাসো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্জি, কিংবা ফেইসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জকারবার্গ, ইন্টারনেটের প্রতিষ্ঠাতা ভিন্ট কার্ফ, চিত্র পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ, অভিনেতা আল পাচিনো, সাহিত্যিক ও নাট্যকার শেস্পপিয়ার, রবীন্দ্র ঠাকুরসহ অন্যান্য গুণী মানুষের প্রতিভা মেধা নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছে! কিন্তু সুন্দর পরিবেশ ও সুযোগ না থাকায় সেই মেধা ও প্রতিভার বিকশিত হতে পারেনি! আমরা জানিনা, হয়তোবা আমাদের পাশের বাড়িতে দরিদ্র একটি শিশুও অসীম মেধার অধিকারী! তাই প্রতিটি শিশুকেই সঠিক পরিবেশ ও সুযোগ দিতে হবে। এটা তাদের অধিকার!