মে দিবস কি? বুঝেন না তাঁরা

আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥  

ইটভাটার বৃদ্ধা শ্রমিক জমিলা বেগমের বয়স ৬০ পেরিয়েছে বছর খানেক আগেই। পুখুরিয়া এলাকায় থাকেন অন্যের দয়ায় এক পরিত্যক্ত ভিটেবাড়িতে। স্বামী মানিক মিয়া বহু আগে তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করছেন। দুই মেয়ে ও এক শিশু ছেলেকে নিয়ে তাঁর কষ্টের সংসার!  সূর্য ওঠার আগেই শুরু হয় তার কাজ; সূর্য ডোবার পরও যেন তা শেষ হয় না। এমনি করে কেটে গেছে জীবনের ৩০ টি বছর। ছেলে এখন বিয়ে শাদী করে আশুলিয়ার থাকে, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকুরি করে। খোঁজ নেয় না দুঃখিনী মায়ের। বৃদ্ধা জমিলার ঠিকানা এখন এন.বি ব্রীক্সের তপ্ত ভাটায়। বয়স হয়ে গেছে, এখন আর আগের মতো শক্তি-সামর্থ্য নেই। তবুও পেটের তাগিদে তার জীবনযুদ্ধ যেন ফুরায় না। বৈশাখের খরতাপ আর চুলার আগুনে যেন ঝলসে গেছে তার শরীর। ‘ও খালা শ্রম দিবস কি’? জানেন কি না প্রশ্ন শুনেই, বললেন, ‘তা তো জানি না বাপু’।

মে দিবস কী জানেন না তিনি। দেশের রাজনীতি নিয়েও তার কোনো ভাবনা নেই। কাজ করেন, আর বেঁচে থাকার জন্য দুমুঠো খান। সকাল গড়িয়ে রাত আবার সকাল। “মে দিবসেও কাজ করুম। কাজ না করলে টেকা পামু কই। টেকা না পাইলে তো না খাইয়া মরতে অইব।’ আক্ষেপ ও দুঃখ মিশেলে এক অনুভূতিকে সঙ্গী করেই জানালেন তিনি।
manikgonj (5)
এই বয়সে কেন এই আগুনের পাশে এত কষ্ট করে কাজ করছেন? পাশে বসে জিজ্ঞেস করতেই “ধুলো-কালি মাখা গাল বেয়ে তরতর করে জল বেরিয়ে ভিজে গেল জমিলার বয়সী ঝাপসা চোখ দুটো। শিশুদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বললেন, “৩ জন পোলাপান রাইখা স্বামী চইলা গেছে। ভাবছিলাম এই পয় পুলাপান (সন্তানাদী) বড় অইয়া (হইয়া) কাম কাইজ কইরা আমার দুঃখ ঘুচাইবো। হেইডাও কপালে সইলো না। তবুও দোয়া করি আল্লায় যেন ওদের সুখে রাখে।” জমিলা বেগম বলেন, ‘আগুনের পাড়ে ১৫০ টাকা রোজের কাম (কাজ) করি। এই বয়সে আর শরীরে কুলায় না। এমন কপাল যেন আল্লায় আর কারেও না দেয় . . . .।

জমিলার মতো এমন হাজারো শ্রমীকেরা জানেন না যে, মে দিবস বা শ্রম দিবস কি? ওরা বোঝেন একদিন কাজ না করলেই না খেয়ে থাকতে হবে। নিতান্তই পেটের তাগিদে ইটভাটার আগুনে ঝলসানো ওদের ভাগ্য। মে দিবস তাদের কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ দিন নয় বলেই পেটের তাগিদে এদিনেও তারা কাজে ব্যস্ত থাকেন। manikgonj (1)-1জীবিকার টানে জীবন যুদ্ধে ভাটার আগুনের সঙ্গে সংগ্রাম করছে নাম না জানা হাজারো নারী শ্রমিক। লক্ষ্য একটাই- সারাদিন রোদে পুড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির পর একমুঠো চাল নিয়ে বাড়ি ফেরা। হয়তো পথের পানে চেয়ে থাকে তাদের পঙ্গু স্বামী আর সন্তানেরা! মে দিবস বা শ্রম দিবস কাকে বলে তাও তারা জানেন না। এরা বেশিরভাগই বিধবা, না হয় স্বামী পরিত্যক্তা। জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বেরিয়ে এসেছে তাদের দুঃখ দুর্দশার কাহিনী।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে আধা কিলোমিটার দূরেই পাঁচটি ইটভাটা। এখানে রয়েছে প্রায় শতাধিক নারী শ্রমিক। পুরষের পাশাপাশি এই ইটভাটায় নারীরা কাঠফাটা রোদে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলেছেন প্রতিদিন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরাম কাজ করছেন তারা। নারী বলে ন্যায্য মজুরিও জুটছে না তাদের কপালে। তারপরও এ বিষয়ে উচ্চস্বরে কেউ কোন শব্দ তুলছেন না। কথা হয় আতা ব্রিকসের নারী শ্রমিক ফুলজান, পাখি, সূর্য বেগম, মরিয়ম, সমীরন, খোদেজা, রূপজান, রেখার মতো  প্রায় ২৫ জন নারী শ্রমিকের সঙ্গে।

এদের একজন ফুলজান বেগম। বয়স ৫০-এর কাছাকাছি। সদর উপজেলার উকিয়ারা গ্রামের শহিদ উদ্দিনের মেয়ে ফুলজানের স্বামী হাকিম উদ্দিন ৭ বছর আগে দুর্ঘটনায় মারা যান। রেখে যান ৪ সন্তান। স্বামীর মৃত্যুর পর তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সন্তানদের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। কখনও মাটি কাটার কাজ, কখনও ইটভাটায় কয়লা ভাঙার কাজ আবার কখনও রাজমিস্ত্রির জোগান দিয়েছেন। ফুলজানের চেহারা রোদ ও আগুনের তাপে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে গেলেও এতটুকু বিশ্রামের অবকাশ নেই তার। হাড়ভাঙা পরিশ্রম  করে  যাচ্ছেন তিনি। কথা বলার এক ফাকে দু’চোখের কোণে পানি টলমল করছিল। বারবার কাপড়ের আঁচল দিয়ে পানি মোছার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে কেঁদে ওঠেন হাউমাউ করে। শুধু বলেন, ‘আমাগোর মতো মানুষের কষ্টের কথা আপনে লেইখ্যা কি করবেন?”

কথা হয় সদর উপজেলার গড়পাড়া ঘোনা গ্রামের নাজমা বেগমের সাথে। তিনি জানালেন, ‘ইটভাটায় কাজ করা আর জাহান্নামের আগুনে পুড়া সমান কথা। সন্তানদের মুখের দিকে তাকাইয়া আগুনে পুড়ে কাজ করতে অয়।‘ শ্রম দিবস কি এ সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। শুধু জানালেন, একদিন কাজ বন্ধ থাকলে সেদিন না খেয়ে থাকতে হবে। আরেক নারী শ্রমিক মরিয়ম বেগম। স্বামী ইমান আলীর মাথায় সমস্যা থাকায় অনেক আগেই স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। কোথায় আছেন কেউ জানেন না। তিন সন্তানকে লালন পালন করতেই তিনি ইটভাটায় নারী শ্রমিক হিসেবে হাড়ভাঙা কাজ করে চলেছেন। মাটি কাটার আরেক নারী শ্রমিক রাহেলা বেওয়া বলেন, “রোদে পুড়ে কাজ করি। কিন্তু উচিত ট্যাহা পাই না। বেটা মাইনষে ( পুরষরা) যদি ৩০০ ট্যাহা পায় তাইলে আমরা কেন ১৭০ ট্যাহা পামু। এই বৈষম্য কি কোনদিন দূর হবে না?”
manikgonj (4)-1
এরকম মাটির কাটার মাঠে, হোটেলের রান্না ঘরে কিংবা ইট ভাটায় কয়েক হাজার নারী শ্রমিক রোদে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। তাদের এই কষ্টের মূল্য কেউ দিচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মাটি কাটা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, মে দিবসে তাদের কাছে কোন গুর”ত্বপূর্ণ দিন নয়। এ দিবসের তাৎপর্য কি তা বেশিরভাগ নারী শ্রমিকই জানেন না। তাই তো মে দিবসেও তারা পেটের তাগিদে কাজ করে থাকেন। তাদের ভাষ্য, একদিন কাজ না করলে ঘরে ছেলে সন্তান নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।

সিমেন্টের চাক-খুঁটি নির্মাণ শ্রমীক রেনু বালা ও আরতী রাজবংশী বলেন, “মে দিবস আছে হুনছি (শুনছি) কিন্তু ওই দিন কি অয় (হয়), কেন অয়? তা জানি না বাপু। আমরা গরিব মানুষ, কাম (কাজ) না করলে পেটে দানা পানি পড়ে না।” কথা হয় ঘিওর উপজেলা বানিয়াজুরী-বাঠুইমুড়ি বেড়িবাঁধের ওপর বসবাসরত মাটি কাটার কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিক শেফালি সরকার, গীতা রাণী সরকার ও ঝর্ণা রাজবংশীর সঙ্গে। এরা তিনজনই বিধবা। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের লালন পালন করতে কেউ ২০ বছর, কেউ ১০ কিংবা ৮ বছর ধরে মাটি কাটার কাজ করে যাচ্ছেন। তিন জনই জানালেন, জীবন সংগ্রাম করে অনেকটা পথ পার করতে হয়েছে তাদের। জীবনের শেষদিকে এসেও কষ্ট তাদের পিছু ছাড়ছে না। আর শ্রম দিবস নিয়ে তাদের নেই কোন মাথাব্যথা। তাদের কথা একটাই- একদিন কাজ না করলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।

happy wheels 2

Comments