অচাষকৃত উদ্ভিদ ব্যবহার করে মাছ ধরার ‘জাইট’ পদ্ধতি

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে বৈচিত্র্যতার অভাব নেই। জাতিগত বৈচিত্র্য, পেশাগত বৈচিত্র্য, প্রাণবৈচিত্র্য- আরো কত কি! এই বৈচিত্র্যতা এখন মানুষের চর্চার মধ্যেও চলে এসেছে।  মগড়া নদীর তীরে লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের গদাইকান্দি গ্রামটি অবস্থিত। এই নদীর তীর ঘেঁষে যে পরিবারগুলো বসবাস করে তাঁদের জীবন জীবিকা এবং প্রাত্যহিক কাজের একটি বৃহৎ অংশজুড়ে আছে এই নদী। তীরের প্রত্যেকটি পরিবার প্রতিদিনের যে সকল কাজে পানি ব্যবহার করে সেটাও এই নদীর পানি। প্রত্যেকের বাড়ির পাশ্ববর্তী সীমানায় নিজেদের মতো করে ঘাট তৈরি করে সেখানে চলে গোসলসহ অন্যান্য ধোয়া মুছার কাজ।

IMG_20180717_115208
আবার বাড়িতে ঘরকন্না বা টয়লেট ব্যবহারের পানিও আসে এই নদী থেকে। আরো একটি বিশেষ কাজে এই নদী এখানকার বাসিন্দাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। কারণ নদী থেকে মাছ ধরে, বিক্রি করে চলে অনেক পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা। বিভিন্ন ধরণের জাল দিয়ে ধরে বড় মাছ, বর্শি দিয়ে বোয়াল মাছ। আর ছোট মাছ ধরার জন্য তাঁরা ব্যবহার করেন ‘সেওড়া’ নামক এক ধরণের অচাষকৃত উদ্ভিদের ডাল ও পাতা। গাছের পাতা ব্যবহার করে মাছ ধরার পদ্ধতির নাম ‘জাইট’ বা ‘ঝুঁপড়ি’ পদ্ধতি।

‘সেওড়া’ গাছ এই অঞ্চলের অতি পরিচিত একটি অচাষকৃত কাষ্ঠল উদ্ভিদ। এই গাছের ডাল হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশেষ পূজা-পার্বণ ও আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। সে কারণে অনেকেই এই গাছ সংরক্ষণ করেন। এই উদ্ভিদটি ঝোঁপ-জঙ্গলে অযত্নে বড় হয়। সেওড়া গাছের পাতা আকারে ছোট ও খসখসে। আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই পাতা দীর্ঘদিন (প্রায় ১৫দিন) পানির নিচে থাকলেও পঁচেনা। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে মাছ শিকারীরা উক্ত গাছের পাতা ব্যবহার করে মাছ ধরেন।

মাছ ধরার ‘জাইট’ বা ‘ঝুঁপড়ি’ পদ্ধতি এই এলাকার অতি প্রচলিত ও জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সেওড়া গাছের ডাল ছোট ছোট করে কেটে একটি খুঁটিতে বাঁধা হয়। তারপর এভাবে কয়েকটি খুঁটি নদীর তীর ঘেঁষে পুঁতে রাখা হয়। এই খুঁটিসহ ঝোঁপের মতো ডাল বাঁধার পদ্ধতিকে স্থানীয় বাসিন্দারা ‘জাইট’ বা ‘ঝুঁপড়ি’ নাম দিয়েছেন। ছোট আকারের বিভিন্ন মাছ যেমন মলা, চিংড়ি, কানপনা, বৈচা, চান্দা, তিত পুঁটি ইত্যাদি মাছ এই ঝোঁপের নিচে জমা হয়। সারাদিন এভাবে রাখার পর বিকেল বেলা ঝুঁপড়ি সরিয়ে ঠেলা জাল (মাছ ধরার এক ধরণের জাল) দিয়ে মাছগুলো সংগ্রহ করা হয়। পরে আবার ডালগুলো জায়গা মতো পুঁতে রাখা হয়। এভাবে একই ঝুঁপড়ি দিয়ে ১৫দিন পর্যন্ত মাছ সংগ্রহ করা যায়। বর্ষাকালে নদীতে পানি বেশি থাকে। তাই এ সময়ে জাইট বেঁধে মাছ ধরার উপযুক্ত সময়।

IMG_20180717_115037
এভাবে কয়েকটি ঝুঁপড়ি থেকে মাছ সংগ্রহ করলে অনেক মাছ পাওয়া যায়। তখন সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে পরিবারের অন্যান্য চাহিদা পূরণ করা যায়। নদীর তাজা মাছ ও ছোট মাছ সবার কাছেই প্রিয়। তাই বাজারে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বিক্রি হয়ে যায় আবার ভালো দামও পাওয়া যায়। বিক্রি করা ছাড়াও সংগৃহীত মাছ দিয়ে নিজেদের পরিবারের চাহিদা মেটান অনেকেই।

এই মাছ ধরার কাজে কোনো পরিশ্রম করতে হয় না। আবার খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই। একজন কৃষক সারাদিন তাঁর কৃষি কাজ সেরে অবসর সময়ে মাছ সংগ্রহ করতে পারেন। তাছাড়া সেওড়া গাছ প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠে বলে দীর্ঘদিন পানিতে থাকলেও নদীর পানির কোনো ক্ষতি হয় না।

একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদে সকলের অধিকার সমান। সেই অধিকারেই গদাইকান্দি গ্রামের বাসিন্দারা নিজেদের মতো করে এই নদী ও নদীর সম্পদ ব্যবহার করেন। শুষ্ক মৌসুমেও তাঁরা নদীতে পানি সংরক্ষণ করে প্রতিদিনের কাজে ব্যবহার করেন। একটি নদীর উপর নির্ভর করেই চলে তাঁদের জীবনযাত্রা।

happy wheels 2

Comments