মূলা ষষ্ঠী পূজায় উদ্ভিদ ও ফল ফসলের ব্যবহার
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
পাবনার চাটমোহরের মূলগ্রামে দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করে আসছেন প্রায় আশি ঘর সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবার। এসব পরিবারের অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নয়। জমা জমি চাষ, কৃষিশ্রম বিক্রি আবার কেউ কেউ মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত আছেন। উৎসবাদীতে জৌলুশ না থাকলেও এখনো তারা পালন করে আসছেন সনাতন ধর্মের নানা আচার। বেশকিছু ষষ্ঠীব্রত পালন করতেও দেখা যায় তাদের। এর মধ্যে মূলা ষষ্ঠী অন্যতম। অশোকা ষষ্ঠী, লুন্ঠন ষষ্ঠী, জামাই ষষ্ঠী, পাটাই ষষ্ঠী, শীতল ষষ্ঠীও পালন করতে দেখা যায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। গত ২৪ নভেম্বর মূলগ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আয়োজন করে মূলা ষষ্ঠী পূজার। অর্ঘ উপাচার হিসেবে উদ্ভিদ ফল ফসলের বিচিত্র ব্যবহার এ পূজার অন্যতম উপকরণ।
শুক্রবার এ গ্রামের দুই স্থানে মূলা ষষ্ঠী পূজার আয়োজন করা হয়। চিকনাই নদীর পাশ^বর্তী দূর্গা ও কালী মন্দিরের প্রাঙ্গনে মাঝখানে মূলা ধানসহ অন্যান্য মৌসুমী ফল ফসল সাজিয়ে গোল হয়ে বসে এক পূজারীর জন্য অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায় চব্বিশ জন বিভিন্ন বয়সী গৃহবধুকে। স্বভাবসুলভভাবে খোঁজ নিতে গেলে কথা হয় মৃত কালীপদ হালদার এর স্ত্রী মায়া রাণী বালা (৬৫) সহ অনেকের সাথে। মায়া রাণী বালা বলেন, “প্রতিবছর এই ষষ্ঠী ব্রতের আয়োজন করি আমরা। প্রত্যেক পূজারী পূজার জন্য ৬টি করে মূলা, ৬টি করে ধানের শীষসহ অন্যান্য উপকরণ এনেছেন। শুভ সূচী ও মঙ্গল কামনায় আমরা এ পূজা দিয়ে থাকি।”
পূজারীদের মাঝখানে কলার মাজ পাতার উপর গাই বাছুর ও পাটায় পেষা আতপ চাল। সামনে দুধ, আপেল, কমলা, বেলপাতা, বাতাবী লেবু, শসা, কলা, আঙ্গুর, পেঁয়ারা, বাতাসা, তুলশী পাতা, জবা ফুল, শিউলী ফুল, দূর্বা ঘাস, মূলা ও ধানের শিষের স্তুপ। চারপাশে গোল হয়ে বসা স্বপ্না, দিপালী, সরলা, সাগরী, বনী, স্বপ্না (২), আলোবালা, লিপি রানী, বন্যা রানী, মিতা, রিমা, লিপি, পূর্ণিমা, নমিতা, সবিতা, পুষ্প, সবিতা (২), শেফালী, রেবা, রূপালী, আখি ও হাসি। ঘণ্টা বাজানোর সাথে সাথে শুরু হয় পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। উলুধ্বনীতে মুখরিত হয় মন্দির প্রাঙ্গণ। থেমে থেমে মূলা ও ধানের স্তুপে সবাই যার যার সাথে নিয়ে আসা পূজার উপকরণ মায়ের উদ্দেশ্যে রাখছিলেন। সবগুলো উপকরণ দেবার পর অপাক্তেয় অংশ তারা শাড়ির আচলে করে নিয়ে সাড়িবদ্ধভাবে বাড়ির পাশর্^বর্তী চিকনাই নদীর ঘাটে গিয়ে জলে বিসর্জন দেন।
ষষ্ঠী পূজা সম্পর্কে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাঁনপুকুর এলাকার প্রিয়াঙ্কা সরকার জানান, বিশেষত কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে যখন নতুন ফসল ঘরে ওঠে তখন মূলা ষষ্ঠী পূজার আয়োজন করা হয়। যাদের সন্তান হয়না সেসকল মহিলা সন্তান লাভের আশায় এবং যাদের সন্তান আছে তারা সন্তানের মঙ্গলার্থে মূলত ষষ্ঠী পূজা করে থাকেন। ভারতের মালদহে এ পূজার আয়োজন বেশি হয়। কথিত আছে, মালদহের বেহুলা নদীর পাড়ে এক সময় লোক বসতি ছিল না। এলাকাটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সেখানে বেহুলা মাকে নিয়ে জুয়া খেলা হয়েছিল। মা মনসার আশীর্বাদ লাভের আশায় এখনো সেখানে ষষ্ঠী পূজা হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে মালদহের বেহুলা নদী পারের নেউড়ি এলাকায় মেলা বসে। আনন্দ উপভোগের জন্য পূজার বিশেষ এ দিনে এখনো সেখানে ছেলে মেয়েসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ জুয়া খেলে থাকেন। মায়ের কৃপা প্রার্থনায় মাকে হরেক রকম খাবার দেয়া হয়। পূজা শেষে অপাক্তেয় অংশ নদীতে বিসর্জন দেয়া হয়।