মাটির স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখি
রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম শহিদ
নওগাঁ নিয়ামতপুর উপজেলার সাবইল-সিনড়া গ্রামের মো. নাসির উদ্দিন (৫০)। তাঁর পরিবারে মা বাবা ও ছোট ভাইয়ের পরিবারসহ মোট ৮ জন সদস্য। মো. নাসির উদ্দিন একজন কৃষক। কৃষি জমিতে ফসল ফলানোর জন্য তিনি মাটিকে সুস্থ রাখার আহ্বান জানান। কারণ তার মতে, মাটি সুস্থ না থাকলে ফসল ভালো হবে না। মাটিতে জৈব উপাদানের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য তিনি তাই কেঁচো সার তৈরি করেন। মো, নাসির মোট আবাদী জমির পরিমাণ ৭০ বিঘা। এ জমিতে তিনি কেঁচো সার ব্যবহার করেন। কেঁচো সারের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার জন্য তিনি নিজেই কেঁচো সার উৎপাদনের দিকে মনোযোগী হয়েছেন। কেঁচো সার কেন উৎপাদন ও ব্যবহার করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায় ও মাটির জৈব ক্ষমতা কমে যায়। আর এভাবে চলতে থাকলে আমাদের মাটি ধীরে ধীরে একদিন ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।” তার মতে, মাটির শক্তি কমে গেলে ফসলে পোকার উৎপাত হয়। এই পোকার উৎপাত কমানোর জন্য তাই মাটিতে বিষ প্রয়োগ না করে বরং প্রাকৃতিকভাবে কীভাবে এই পোকাগুলো তাড়ানো যায় সেই চিন্তা তিনি করেন। তার মতে, জমিতে বিষ ও রাসায়নিক সার না দিলে সেই জমিতে পোকা খাওয়ার জন্য পাখি আসে। পাখিরাই এসব পোকা খেয়ে ফসল রক্ষা করে। তিনি বলেন, “ফসলের উপকারী বন্য পাখি বর্তমানে আমাদের অঞ্চলে কমে গেছে। তাই মাটির জৈব শক্তি ফিরে আনার জন্যই আমি কেঁচো সার উৎপাদন ও ব্যবহার করি। এতে করে আমার জমিতে পাখি আসবে এবং পোকা খেয়ে ফেলবে।”
কিভাবে কাজটি শুরু করেছেন এবং কার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন জানতে চাইলে মো. নাসির উদ্দিন বলেন, “আমি চ্যানেল আইয়ের কৃষি বিষয়ক ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান দেখে নিজ উদ্যোগে কেঁচো সার তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠি।” তার এই উদ্যোগকে সফলতার মুখ দেখানোর জন্য তিনি তাই সাপাহার উপজেলার ফুরকুটি গ্রামের একজন উদ্যোগী কৃষক আব্দুল কুদ্দুসের কাছ থেকে ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে এক হাজার (১০০০) কেঁচো আনেন। ওই কৃষকের কাছ থেকে কেঁচোর সার তৈরির কৌশল শিখে বর্তমানে নিজেই নিজেই এসব পরিচর্যা করেন। চলতি বছরে (২০১৬) তিনি দুই (২) মণ কেঁচোর সার উৎপাদন করেন। এ সার ব্যবহার করে তিনি পেঁয়াজ, রসুন ও ঝাল চাষ করেছেন। এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, “রাসায়নিক সার দিয়ে চাষ করলে দ্রুত শক্তি পায় কিছুদিন পরে আবার ফসল থেমে যায়। কিন্তু কেঁচো সার ব্যবহার করে ফসলে শেষ পর্যন্ত শক্তি ধরে রাখে।”
ধানের জমিতে কেঁচো সার ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি কুদ্দুসের ধান ক্ষেতে পরীক্ষা করে দেখেছি। ধানের জমিতে ব্যবহার করলে ধানের শিশে চিটা কম হয়।” এই অভিজ্ঞা থেকেই তিনি উৎপাদিত কেঁচো সার জমা করছেন ধানের জমিতে ব্যবহারের জন্য। বর্তমানে তাঁর কেঁচো বেড়ে প্রায় দশ হাজার হয়েছে। কেঁচো বাড়ার সাথে সাথে তিনি আরও দুটি নতুন হাউজ তৈরি করেছেন যাতে করে আরও বেশি করে উৎপাদন করে সারের চাহিদা পূরণ করতে পারেন। নতুন কেঁচো সার তৈরির ঘর সম্পর্কে তিনি বলেন, “সেই ঘরগুলোতেও কেঁচো সেট করা হবে এবং আগ্রহী কৃষকদের মাঝে পর্যায় ক্রমে সম্প্রসারণ করবো।”
মো. নাসির উদ্দিন শুধু জৈব সার ব্যবহার করেন না; বরং জমিতে বাজারের কীটনাশকের পরিবর্তে তিনি জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করেন। জৈব বালাইনাশক তৈরিতে তিনি মেহগণির পাতা ও ফল ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, “আমি জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করতে চাই না। তাই আমি জৈব বালাইনাশক পদ্ধতি শিখতে চাই এবং সেটা ব্যবহার করতে চাই। কারণ আমরা প্রতিনিয়ত বিষ খাচ্ছি।”
তিনি মনে করেন জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করলে ফসলের জমির জন্য ভালো। কারণ এতে করে মাটির ভেতরে বিভিন্ন ধরনের উপকারী প্রাণ বেঁচে যায়। নাসির বলেন, “প্রতিনিয়ত আমাদের জমিতে বিভিন্ন ধরনের পোকা তৈরি হয় আর পাখিরা এসব পোকা খেয়ে জীবন ধারন করে কিন্তু কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আমাদের অঞ্চলে পাখি কমে যাচ্ছে। তাই আমাদের উচিৎ পোকার বিষ কেনার টাকা দিয়ে পাখির আবাস স্থল তৈরি করা। তাহলে আমাদের ফসলকে পাখি সুরক্ষা দিবে এবং পরিবেশেরও ক্ষতি হবে না।”