পরিবেশ রক্ষায় যুবকদের উদ্যোগে সাজনা চারা রোপণ
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
নেত্রকোনা অঞ্চলে একদা ছিল বৈচিত্র্যময় ফলের সমাহার। বর্তমানে দিন দিন কমে যাচ্ছে বৈচিত্র্যময় এসব ফল গাছের সংখ্যা, কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের এসব দেশীয় ফলের জাত। এলাকার বাস্তুসংস্থান, পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্যের কথা চিন্তা না করে জনগণ বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন স্থানে একাশিয়া, ইউক্যালিপটাশ, আকাশমনি, রেইন্ট্রি, মেহগনি গাছসহ বিভিন্ন জাতের আগ্রাসী গাছ রোপণ করছেন। এর ফলে বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধি ও বাতাসে অক্সিজেন বৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে। আগ্রাসী প্রজাতির গাছগুলো আমাদের পরিবেশের জন্য উপযোগি না হওয়ায় প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এসব আগ্রাসী প্রজাতির গাছের নিচে অন্য কোন গাছ জন্মাতে না পারায় আমাদের দেশের অনেক ছোট ছোট গাছ ও লতাগুল্ম বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আগ্রাসী প্রজাতির গাছগুলোতে পাখি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের খাবার ও আশ্রয় নেয়ার মত পরিবেশ না থাকায় গাছের উপর নির্ভরশীল এসব প্রাণী বিলুপ্তির উপক্রম হচ্ছে। এসব আগ্রাসী প্রজাতির গাছের সম্প্রসারণের ফলে এলাকার জনগোষ্ঠী ভুলে যাচ্ছে পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিলুপ্তপ্রায় কিছু পাখি প্রজাতি ও কীটপতঙ্গের টিকে থাকার জন্য আবশ্যক এমন কিছু গাছ রোপণের প্রয়োজনীয়তা। এসব গাছের প্রজাতির মধ্যে অন্যতম সাজনা গাছ। যে গাছের পাতা ও ফল (সাজনা শাক ও সাজনা) প্রচুর পরিমাণে ভিটামিনসমৃদ্ধ। এর শাক ও সাজনা উভয়ের বাজারমূল্যও বেশি এবং চাহিদাও বেশি। ভেষজ চিকিৎসকদের মাধ্যমে জানা যায়, সাজনা গাছের শিকড়ের রস উচ্চ রক্তচাপ, বাত ব্যাথা ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।
নেত্রকোনা অঞ্চলে বারসিক এর মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে ওঠা বেশকিছু জনসংগঠন রয়েছে, (যেমন-কৃষক, নারী, যুব ও কিশোর-কিশোরী সংগঠন, জেলা, আদিবাসী জনসংগঠন, দলিত সংগঠন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) যেগুলো এলাকায় স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় কাঠ, ঔষধি, ফুল ও ফলজ গাছের বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে বেশ কয়েক বছর যাবৎ বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। এমনই একটি জনসংগঠন নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের বালি গ্রমের ‘বালি যুব সংগঠন’। সংগঠনটি গঠনের পর থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষায় নিজ এলাকা ও এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষ রোপণ করে আসছে। পরিবেশ সুরক্ষা, পুষ্টির চাহিদা পূরণ, ফলজ চারা রোপণ, ঔষধি চারা রোপণ, ঔষধি উদ্ভিদের গুরুত্ব নতুন প্রজন্মের নিকট তুলে ধরা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিসহ প্রাণবৈচিত্র্যের উন্নয়নে এ যুব সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ যেমন-বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, মাদক প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন বন্ধকরণ, যুবকদের বই পড়ায় ও সাংস্কৃতিক চর্চায় উদ্বুদ্ধকরণ এবং খেলাধূলার মাধ্যমে বিনোদনের আয়োজন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় যুব সংগঠনটি সাজনা শাক, সাজনা ও সাজনা গাছের শিকড়ের উপকারিতা জানার পর নিজ গ্রামটিকে (বালি) সাজনা গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। উদ্যোগ বাস্তবায়নে যুব সংগঠনটি মনাং গ্রামের কুসুমকলি নারী সংগঠনের সহযোগিতায় ৩০০টি সাজনার চারা (ডাল) সংগ্রহ করে সদস্যদের মাধ্যমে গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবারে ২টি করে সাজনার চারা বিতরণ করে এবং নিজেরা উপস্থিত থেকে গ্রামের যুবক, প্রবীণ, শিশু ও নারীদের অংশগ্রহণে চারাগুলো রোপণ করে।
সাজনার চারা রোপণ কার্যক্রমের শুরুতে সাজনা শাক ও সাজনার পুষ্টিগুণ নিয়ে আলোচনা করেন গ্রামের প্রবীণ কৃষক মো. জব্বার আলী। তিনি বলেন, ‘সাজনা পাতা ভাজি করে খেলে শরীরের কোন বিষ ব্যাথা থাকে না। সাজনার ডাল ও শিকড় দিয়ে ঔষধ বানানো যায়, সেই ঔষধের অনেক উপকারিতা। আগে আমাদের এত ঔষধ খেতে হত না, কারণ সাজনা, নিম, হরতকি, তুলসীসহ অনেক ধরনের ঔষধি গাছ ছিল, এখন আর এগুলো পাওয়া যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাজনা ও সাজনা শাক অনেক সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার। কিন্তু সারা গ্রাম খুঁজলেও একটা সাজনা গাছ দেখা যায় না। বাজারে প্রতি কেজি সাজনা সর্বনি¤œ ষাট টাকা দামে বিক্রি হয়। সাজনা শাক বাজারে পাওয়াই যায় না। আমরা গ্রামের মানুষ সাজনা শাকের কদর করতে জানি না। অথচ শহরের বাজারের সাজনা শাক তোলার সাথে সাথেই ভালো দামে বিক্রি হয়ে যায়। শহরের লোকদের নিকট সাজনা শাক ও সাজার কদর অনেক বেশি। তাই আমি অনেক গর্বিত যুব সংগঠনের কাজে। যুব সংগঠনের উদ্যোগেই আমাদের গ্রামে আজ ৩০০টি সাজনা চারা রোপণ করা সম্ভব হয়েছে।’
যুবক পরাগ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে বেশি বেশি বৈচিত্র্যময় গাছের চারা রোপণ করতে হবে। আমাদের বেঁচে থাকতে হলে পুষ্টির প্রয়োজন আছে, তাই আমরা যদি প্রতিবছর বৈচিত্র্যময় গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিই তাহলে পুষ্টির চাহিদা যেমন পূরণ হবে তেমনি প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা পাব। আমরা বালি যুব সংগঠনের উদ্যোগে এই বছর ফলের চারা রোপণ করেছি প্রায় ১০০টি এবং সাজনা চারা রোপণ করেছি ৩০০টি। আমারা প্রতি বছরই সাজনা চারা রোপণ করব। আমাদের গ্রামের তিন কিলোমিটার রাস্তায় তাল বীজ রোপণ করব। প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে বাচঁতে হলে তাল বীজ রোপণ করা আমাদের প্রয়োজন।’
স্কুল শিক্ষক মমতা আক্তার বলেন, ‘এলাকায় ফলদ ও ঔষধি চারা বৃদ্ধি পেলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করবে। দেশীয় ফল এলাকায় বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে আমরা বৈচিত্র্যময় স্বাদের ফল যেমন খেতে পারব, তেমনি আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে এবং পুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকব। তাই যুব সংগঠনের কার্যক্রমকে আমি স্বাদুবাদ জানাই।’
পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নে যুবদের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে এলাকার ভবিষ্যত প্রজন্ম প্রাকৃতির সাথে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে, পাশাপাশি পুষ্টির চাহিদাও পূরণ হবে। যুব সমাজ প্রকৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নমূলক কাজে লিপ্ত থাকায় অসামাজিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবে এবং সুখী ও শান্তিপূর্ণ বহুত্ববাদী সমাজ গড়ে তোলায় সহায়তা করবে।