হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ‘পালকি’ আজ বিলুপ্তির পথে
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ থেকে
হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ‘পালকি’। একসময়ে বিয়ের বর-কনে বাহনের অন্যতম মাধ্যম ছিল পালকি। গ্রামের পথে ভেসে আসছে ‘হুনহুনা’ ‘হুনহুনা’ ধ্বনি। তালে তালে পা ফেলে, সুরেলা ছন্দময় ধ্বনি ছড়িয়ে তারা পালকিতে বয়ে নিচ্ছে নব বধূ কিংবা বর। রঙিন ঝালর দেয়া আর নানা রঙের ফুল ও কাগজে সাজানো পালকির ভেতর ঘোমটা দেয়া বধূর মুখখানি দেখতে আশপাশের মানুষ এসে দাঁড়ায় রাস্তার পাশে। লাজুক মুখে নববধূও দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ ফেলে বাইরে। এখন আর সেই আবিষ্ট করা হুনহুনা ধ্বনি ভেসে আসে না কোথাও। কালপরিক্রমায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহন পালকি আজ বিলুপ্তির পথে।
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, একসময় শুধু বধূ বহন নয়, অভিজাত শ্রেণির মানুষ ও রাজরাজড়াদেরও প্রধান বাহন ছিল পালকি। সেই পালকির ছিল কত না রূপ, কত না রকম। পালকির ব্যবহার কখন কিভাবে এদেশে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে মোগল ও পাঠান আমলে বাদশাহ, সুলতান, বেগম ও শাহাজাদীরা পালকিতে যাতায়াত করতেন। দেশি-বিদেশি পরিবাহক ও ঐতিহাসিকদের তথ্য ও গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু ও ১৯৩০-সালে শহরাঞ্চলে রিক্সার প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার কমতে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত প্রসার, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্যান্য যান জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।
মানিকগঞ্জের নয়াডিঙ্গী গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধা ফুলতারা বেওয়ার কানে এখনো ধ্বনিত হয় সেই হুনহুনা ধ্বনি আর দুলুনি। বাপের বাড়ি কাটিগ্রাম ছেড়ে মাত্র ১২ বছর বয়সে পালকিতে চড়ে স্বামীর ঘরে এসেছিলেন তিনি। জীবন শেষ বেলায় এসে এখনো তার মনে পড়ে সেই দিনের স্মৃতি। তিনি বলেন, “গ্রামেগঞ্জে বিয়ের বর-কনেকে পালকিতে তুলে বেহারারা বয়ে নিয়ে চলত। তাদের মুখ থাকতো ছন্দের ‘হুনহুনা’ ‘হুনহুনা’ সুর।”
কালে-ভদ্রে কেউ কেউ শখের বশে কিংবা অনুষ্ঠানে ভিন্নতা আনতে পালকির খোঁজ করেন। তবে নগর জীবনে আজকাল কদর বেড়েছে পালকিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার। সম্প্রতি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ঢাকার ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নীলিমা আফরোজ পালকিতে চড়ার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, ‘পালকিতে চড়ে বিয়ে হবে এটা স্বপ্নের ব্যাপার। স্বপ্নটা সত্যি হয়েছে। খুবই ভালো লাগছে। কারণ আজকাল পালকির ব্যবহার আগের মতো নেই। এ কারণে বেশ আনন্দ লাগছে।” রাজধানির জনপ্রিয় পেশাদার ফটোগ্রাফার ভ্যালেনটাইন অনন্য গোমেজ বলেন, “ইদানিং শহুরে জীবনেও অনেক বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় পালকির ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের দেশীয় সুপ্রাচীন সংষ্কৃতির প্রচলন গর্বের বিষয়।
মানিকঞ্জর ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী মাঝিপাড়া গ্রামের পালকি বাহক কাহার সম্প্রদায়ের অনীল কাহার, তিল্লী এলাকার শমসের আলী, কছিম উদ্দিন পাঠানসহ কয়েকজন জানান, তাদের বাপ-দাদারা গ্রামে-গঞ্জে পালকির বেহারা হিসেবে কাজ করতেন। যৌবনে গায়ে শক্তি থাকতে তারাও এ পেশাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বহু কষ্টে দিনাতিপাত করছেন বলে জানান। তারা বলেন, “এখন পেশা ছেড়ে বৃদ্ধ বয়সে কাঠ মিস্ত্রি হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছি।”
ঘিওর সরকারি ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক অজয় রায় বললেন, সংস্কৃত ‘পল্যঙ্ক’ বা ‘পর্যঙ্ক’ থেকে বাংলায় উদ্ভূত ‘পালকি’। বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য “পালকি” বিভিন্ন আকৃতি ও ধরনের হয়ে থাকে। সেগুন কাঠ, শিমুল কাঠ দিয়েও বানানো হতো পালকি। বটগাছের বড় ঝুরি দিয়ে তৈরি করা হতো পালকির বাঁট। সাধারণত তিন ধরনের পালকি বানানো হতো। সাধারণ পালকি, আয়না পালকি ও ময়ূরপঙ্খী পালকি। সবচেয়ে ছোট পালকি ‘ডুলি’ বহন করে দুই বেহারা। বড় পালকি চলে চার বেহারা ও আট বেহারায়।