সমাজ-রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও তরুণশক্তি
সিলভানুস লামিন
এক
বলা হয়, বিশ্বের সবচে’ শক্তিশালী সম্মিলিত শক্তি হচ্ছে তরুণদের শক্তি। স্বাভাবিকভাবেই তরুণদের সংগঠন হচ্ছে সবচে’ শক্তিশালী সংগঠন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক তরুণ সংগঠন রয়েছে, রয়েছে সেগুলোর বিশাল কাজের পরিধি, প্রভাব ও সফলতা। তরুণ সংগঠনগুলোর সাফল্যের পেছনে রয়েছে তরুণদের প্রাণশক্তি, তারুণ্য, মনোবল ও ঝুঁকি মোকাবিলায় তাদের দক্ষতা। তরুণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনেক অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়েছে, অনেক কঠিন কাজ সম্পাদিত হয়েছে, অনেক দাবি-দাওয়া ও অধিকার আদায় হয়েছে! তরুণরা উচ্ছল, স্বতঃস্ফূর্ত ও নতুন কিছু জানা ও সৃষ্টির করার প্রবল আকাঙ্খা রয়েছে তাদের ভেতরে! তবে নানাভাবে এই তরুণশক্তিকে ইতিবাচক কাজে না লাগিয়ে ধ্বংসাত্মক কাজে লাগানো হয়েছে অনেকসময়, অনেকসময় আবার সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এই শক্তি বিপথে চালিত হয়েছে। অথচ এই শক্তিকে ইতিবাচক কাজে লাগাতে পারলে সেটি হবে সব সমস্যার সমাধানের প্রধান কৌশল, উপায় ও অবলম্বন। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজে কি রাষ্ট্রে শান্তি, প্রগতি ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে! মূলত সমাজের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিতকরণ, এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন কর্মপন্থা বা কর্মসূটি প্রণয়ন এবং এ সমাজের অন্ধকারের দিকগুলো দুরীভূত করে একটি আলোকিত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই যুব সংগঠনগুলোর আর্বিভাব হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। বর্তমান তরুণদের সুদুরপ্রসারী চিন্তা-চেতনার অধিকারী ও তা ধারণ করার মতো আমাদের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক’ সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে তরুণরা বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সমাজের সমস্যা তুলে ধরেছেন, বিভিন্ন অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন এবং তাদের মতো তরুণদের উৎসাহিত, উদ্বুদ্ধ বা প্রেষণা দিচ্ছেন। আমরা আনন্দিত হই যখন দেখি শহর কি গ্রামে তরুণরা নানান উদ্যোগ নিয়েছেন বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য! এসব তরুণদের মনোবল অদম্য, নতুন কিছু সৃষ্টি করার আকাঙ্খা প্রবল এবং তাদের নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ সৃষ্টি করার প্রক্রিয়াগুলো খুব সচল ও শক্তিশালী। আশা করি, দিনকে দিন আরও সামনের দিকে এই তরুণরা এগিয়ে যাবে। আরও অনেক নতুন নেতানেত্রী বেরিয়ে আসবে তাদের মধ্য থেকে এবং সমাজের জন্য কল্যাণ ও মঙ্গলকর কিছু করার জন্য আরও অনেক সমাজসেবক (Social Actors) তৈরি হবে! তাদের পথচলা আরও গোছালো, আরও সক্রিয়, আরও উদীপ্ত এবং আরও প্রাণবন্ত করার জন্য এই লেখার মাধ্যমে আমি কিছু বিষয় সহভাগিতা করতে চাই! হয়তোবা আমি যা সহভাগিতা করতে যাচ্ছি সেই বিষয়টি সম্পর্কে তাদের পূর্ব ধারণা রয়েছে! কিন্তু বাস্তবে সেই অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারেনি নানা প্রতিবন্ধতায় ও সীমাবদ্ধতায়! তাই সেই ধারণাগুলোর বাস্তব অনুবাদ বা প্রয়োগে তাদের উজ্জীবিত করাই মূলত এই লেখাটি। আর সে সম্পর্কে তাদের যদি কোন ধারণা তাদের নাও থাকে তাহলে এ বিষয়টি জেনে তারা তাদের এই পথচলাকে আরও সুসংগঠিত, আরও সুদৃঢ় করবে বলে আমি বিশ্বাস করি!
দুই
আমরা সবাই নিজেদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করি। আমি কি খাব, কি করবো, কি পরবো, কোথায় যাব এবং কেন যাব ইত্যাদি বিষয়ে সবসময় নিজের সাথে যোগাযোগ করি। এটাকে আর্ন্তব্যক্তিক যোগাযোগ (Intrapersonal communication) বলে। এই যে, আমরা সব সময়ই নিজেদের সাথে যোগাযোগ করি সেই যোগাযোগটা অন্যের সাথেও করতে হবে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনের জন্য। আমরা সবাই আমাদের নিজস্ব জগতের নেতা। আমাদের নিজস্ব একটা ‘জগতে’ আমরাই মহাত্মা গান্ধাী, আমরাই নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা হালের ওবামা! আমাদের জগতের নেতা কিন্তু আমরাই! অর্থ্যাৎ আমরা জন্মগতভাবেই এক একজন নেতা। এই নেতৃত্বগুণ বিকাশের জন্য আমাদের সবাইকে সবার সাথে মিথষ্ক্রিয়া করতে হবে। আমরা সবাই কিন্তু স্বতন্ত্র! আমার মতো করে চিন্তা করে, ভাবে পৃথিবীতে আরও কেউ আসবে না; আমার মতো সাদৃশ্য চেহারার মানুষ পৃথিবীতে আরও ৫ জন আছে (বিজ্ঞানীদের মতে) কিন্তু আমার মতো চিন্তা করে, ভাবে আর একটিও আসবে না! সুতরাং আমি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কে জানে আমার একটা চিন্তা, ভাবনা, পরিকল্পনা হয়তোবা সমাজে বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে, আমার মতামত পৃথিবীতে শান্তি আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে! আমি অনেক তরুণকে দেখেছি, অমিত সম্ভাবনা ও মেধা থাকার পরও নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। সামনে এগিয়ে আসতে চায় না। সভা হলে চুপচাপ বসে থাকে। তারা ভাবে যে, আমি কথা বললে ভুল হতে পারে, আমার মতামত শুনে অনেকে হাসতে পারে! ফলে তাদের মতামত, তাদের চিন্তা আর প্রকাশ পায় না। চুপ থাকা এবং মতামত ব্যক্ত না করার এই প্রবণতা বা মানসিকতাকে সমাজবিজ্ঞানীরা ‘নিবরতার কুণ্ডলী’ (Spiril of silence) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কোন মানুষ যখন নিরবতার কুণ্ডলীতে অবস্থান করে তখন তার সহজাত নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা বিনষ্ট হয়! আমার ভেতরে সুপ্ত প্রতিভা এবং সেই প্রতিভা বিকশিত করার পরিবেশ থাকার পরও আমি যদি সেটি ব্যবহার না করি তাহলে সেটি এক ধরনের সামাজিক ‘অপরাধ’! আমরা কেন সামাজিক অপরাধে অপরাধী হবো? যোসেফ ও হ্যারি (Joseph and Harry) নামে দু’জন ব্যক্তি মানবজীবনে একটি জানালার অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তাদের নামেই এই জানালাটা পরিচিত। এই জানালাকে জোহারি ইউন্ডো (Johari Window) বলা হয়। তাদের দেখানো এই জানালাতে মানবজীবনের চারটি দিক উল্লেখ রয়েছে সেগুলো হলো উন্মুক্ততা (Openness), লুকায়িত (Hidden), অন্ধত্ব/মুদ্রা দোষ (Blindness) এবং অনিশ্চয়তা (Uncertain)। তারা বলেছেন, মানুষ হিসেবে আমরা যে বিষয়টি উন্মুক্ত (Open) বা প্রকাশ করি সেটা আমরা নিজেরা জানি এবং অন্যরা তা জানেন। যেমন আমার নামটি। আমরা নামটি আমি জানি এবং আমার বন্ধুরাও জানে। আবার আমরা যে বিষয়টি লুকিয়ে রাখি (Hidden) বা প্রকাশ করি না সেটা কেবলমাত্র আমরাই জানি; আমার বন্ধু বা অন্যরা নয়। অন্যদিকে তারা বলেছেন, মানুষ হিসেবে আমাদের কিছু দোষত্রুটি থাকে, মুদ্রা দোষ (Blindness) রয়েছে যেগুলো হযতো আমি জানিনা কিন্তু অন্যরা জানে। আবার আমাদের জীবনে অনেককিছু আছে যেগুলো অনিশ্চিত (Uncertain), কি হবে তা সম্পর্কে আমরা নিজেরা যেমন জানিনা তেমনিভাবে অন্যরাও জানেন না। আমরা কেবল সেই অনিশ্চয়তা সম্পর্কে পূর্বানুমান করতে পারি মাত্র! এই উদাহরণটা আমি এজন্যই টেনেছি যে, যাতে আমার নিজেদের প্রকাশ করি, উন্মুক্ত করি! আমার মতামত, আমার চিন্তা প্রকাশ করি। যতবেশি আমি নিজেকে প্রকাশ করি ততবেশি আমি শিখতে পারবো বা শিখাতে পারবো, ততবেশি আমি আমার ভুলত্রুটি শোধরানোর সুযোগ পাব! যতবেশি আমি আমার ভেতরের বিষয়গুলো সহভাগিতা করবো ততবেশি সেটি সমাজের কল্যাণ করতে ভূমিকা রাখতে পারে! আমি তো বলেছিই হয়তো আমার একটি চিন্তা সমাজের বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে! তবে মনে রাখতে হবে, সবকিছুরই একটা সীমা থাকা দরকার। নিজেকে অতিরিক্ত প্রকাশ করতে গিয়ে যাতে আমি অন্যের ক্ষতি না করি, নিজের ক্ষতি না করি এবং অন্যের ওপর আমার মতামত চাপিয়ে না দিই সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে!
তিন
আমরা পড়াশোনা করি জ্ঞানার্জনের জন্য, নিজেকে ভবিষ্যতে তৈরি করার জন্য এবং সর্বোপরি নিজেকে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। আমার সমাজকে আমি তখন আলোকিত করতে পারবো যখন সেই আলোটা আমার কাছে থাকে! আমার কাছে থাকা এই আলোর বিচ্ছরণ ঘটবে সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে! তাই আমরা সমাজের নানান ইস্যু নিয়ে কথা বলবো, উদ্যোগ নেব সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার জন্য তবে পড়াশোনাকে অবশ্যই জলাঞ্জলী দিয়ে নয়! মনে রাখবো, আমরা যত বেশি শিক্ষিত হবো, যত বেশি জ্ঞানার্জন করবো ততবেশি ভালো ভূমিকা রাখতে পারবো সাংগঠনিক কাজে! সোজা কথা, আমাদেরকে স্মার্ট হতে হবে। আমরা কি শিখেছি, কি করেছি এ সময় পর্যন্ত বা যখন কোন উদ্যোগ নিই আমাদের উদ্যোগুলোর সবল ও সীমাবদ্ধতা কি সেগুলো মূল্যায়নের জন্য নিজেদের জন্য সময় বরাদ্দ রাখা স্মার্টনেস এর কাজ। আমরা যদি আমাদের সম্পর্কে ভালো মূল্যায়ন করতে পারি তাহলে যেকোন কিছু করার আগেই আমরা যে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবো সেটিও কার্যকর ও SMART হবে। SMART ইংরেজি শব্দটিকে ব্যবচ্ছেদ করলে আমরা পাই S=Specific, M=Measurable, A=Achievable, R=Relevant/Realistic এবং T=Timely। তাই আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই স্মার্ট হই তাহলে আমরা একটি সুনির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য, অর্জনযোগ্য এবং সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়নে সমর্থ হবো আমাদের নিজেদের ও সমাজের জন্য। একটি স্মার্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণীত হলে কাঙ্খিত লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যায়! আত্মমূল্যায়ন এবং জীবনের জন্য একটি SMART পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য আমাদের শিক্ষালাভ করতে হবে, আরও উচ্চশিক্ষিত ও জ্ঞার্নাজন করতে হবে। এজন্য নিজেকে সবসময় Update রাখতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি সমাজে, রাষ্ট্রে ও বিশ্বে কি হচ্ছে, কি ঘটছে সে বিষয়ে জ্ঞান রাখতে হবে, চোখ-কান খোলা রাখতে হবে! তথ্য দিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে হবে। আমার কাছে যদি তথ্য থাকে, আমি যদি সমসাময়িক বিষয়ে অবগত থাকি এবং সেগুলো যদি আমি ভালোমত পরিবেশন করতে পারি তাহলে আমি সুন্দর ও সাবলীলভাবে মানুষকে প্রেষণা দিতে পারবো। এজন্যই Updated হওয়ার পাশাপাশি আমার নিজেকে প্রতিনিয়ত Upgrade করতে হবে। আমার পরিবেশনা, উপস্থাপনা এবং অন্যকে প্রভাবিত করার দক্ষতা ও সক্ষমতা দিন দিন যদি উন্নত হয়, আকর্ষণীয় হয় এবং পূর্বের তুলনায় আরও কার্যকর হয় তাহলে বুঝতে হবে আমি নিজেকে আপগ্রেড করেছি! আমাদেরকে তাই প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে Update ও Upgrade করার চেষ্টা করতে হবে!
চার
আমি বলেছি আমরা জন্মগতভাবে এক একজন নেতা, নিজের জীবনের নেতা, আমার অভ্যন্তরীণ জগতের নেতা। আমার নেতৃত্বগুণকে আমি যখন আমার জগত ছাড়া আমার মতো অন্য মানুষের জগতেও সমানভাবে আলো ছড়াতে পারি, প্রভাবিত করতে পারি ভালো কাজে, আমার এই গুণ অন্যদেরকে যখন সম্মোহন করে তখন বুঝতে হবে যে, আমি তাদের প্রভাবিত করতে পারি। বলতে চাই যে, সমাজের নেতা হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়; এটি জন্মগতভাবে লাভ করতে পারি না। এটাকে অর্জন করতে হয়! কীভাবে সেই গুণ অর্জন করবো আমি? যোগাযোগের সম্পর্কে প্লেটো একটি কথা বলেছেন যে, যোগাযোগ হচ্ছে কথার মাধ্যমে মানুষের মন জয় করা! যদিওবা কথা ছাড়াও আমাদের অবাচনিক দিকগুলোও এতে সমানভাবে এতে ভূমিকা রাখে। এই প্রসঙ্গটি অবতারণার অর্থ হলো, একজন নেতা হতে হলে মানুষের মনকে জয় করার বাচনিক ও অবাচনিক সমক্ষমতা আমাদের থাকতে হয়! এজন্য বলা হয়, নেতা তৈরি হয়, জন্ম হয় না! একজন নেতা সেই যিনি মানুষের ভেতরের কর্মস্পৃহা বের করতে পারেন, মানুষকে উৎসাহিত করতে পারেন, তাদের দিকনির্দেশনা দিতে পারেন, মানুষের ভেতরের সম্ভাবনা ও শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারেন। নেতা যেমন বন্ধুভাবাপন্ন হন, তেমনি তাকে অনেকসময় কঠোর হতে হয়। নেতাকে প্রতুৎপন্নমতি হতে হয়, বাস্তববাদী হতে হয়, সঠিক সিদান্ত নেওয়ার ও তা বাস্তবায়নের করার সক্ষমতা ও দক্ষতা তাকে থাকতে হয়। নেতা সবার সাথে মেশেন, কথা বলেন, মানুষের ‘বলা কথা’ ও ‘না বলা কথাগুলো’কে সমানভাবে শুনেন, পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করতে পারেন। নেতা একজন সহায়ক, প্রশিক্ষক নন! এছাড়া নেতাকে শিক্ষিত, সৎ, আন্তরিক, ক্ষমাশীল, নিবেদিতপ্রাণসহ আরও অনেকগুণের অধিকারী হতে হয়! আমরা লক্ষ্য করি, এই গুণগুলো কি আমার আছে? এই গুণগুলোর কোনটি না কোনটি নিশ্চয়ই আমার আছে তবে হয়তোবা সেই গুণ আমি সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারিনি! সবগুলো গুণই যে একজন নেতার থাকতে হবে তা কিন্তু নয় বরং কোন নিদির্ষ্ট গুণের সঠিক ও সময়োপযোগী প্রয়োগের মাধ্যমেও আমি একজন ভালো ও সফল নেতা হতে পারি। নেত্বত্ব দেওয়ার সময় আমার কথা, আমার মতামত ও আমার চিন্তা যাতে সবার ওপর চাপিয়ে না দিই বরং সবার মতামত ও সিদ্ধান্ত এবং পরামর্শকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারি সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে!
পাঁচ
একজন নেতাকে মনে রাখতে হয় যে, সবাই সমানভাবে চিন্তা করেনা, সবাই একই বিষয়ে সহমত পোষণ করতে পারে না। সবারই আলাদা জগত রয়েছে, সবাই তার মতো করে চিন্তা করে, বিশ্লেষণ করে। এজন্যই এডয়ার্ড ডিবোনো (Adward Debono) বলেছেন, পৃথিবীতে ৬ ধরনের চিন্তাধারী মানুষ রয়েছেন। এটাকে তিনি ৬টি চিন্তা টুপি (Six Thinking hats) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি ৬টি রঙের টুপির মাধ্যমে মানুষের চিন্তাকে ব্যাখ্যা করেছেন। এ ৬টি রঙিন টুপিগুলো যথাক্রমে ১. সাদা টুপি, ২. লাল টুপি, ৩. কালো টুপি, ৪. হলুদ টুপি, ৫. সবুজ টুপি এবং ৬. নীল টুপি। সাদা টুপিধারী মানুষেরা তথ্য, বাস্তবতা, প্রাসঙ্গিকতা ও ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিন্তা করেন, লাল টুপিধারী মানুষেরা কোনকিছু করার ক্ষেত্রে আবেগকে খুব প্রশ্রয় দেন, কালো টুপিধারী মানুষেরা ‘আমার কথা ঠিক কি না, এটা করলে ঝুঁকি হবে কিনা, সমস্যা দেখা দেবে কিনা’ সবসময় তা নিয়ে সংকোচে থাকেন, হলুদ টুপিধারী মানুষেরা খুব আশাবাদী ও ইতিবাচক হন, লাভ বা সুযোগ নিয়ে চিন্তা করেন সবসময়, সবুজ টুপিধারী মানুষেরা নতুন কিছু করা, নতুনত্ব, অভিনবত্ব, নতুন ধারণা ও সম্ভাব্য বিকল্প নিয়ে চিন্তা করেন এবং নীল টুপিধারী মানুষেরা কাজ করার পরিকল্পনা করেন, চিন্তাকে কাজে অনুবাদ করেন, পরিমাপ, পরীবিক্ষণ, লক্ষ্য নির্ধারণ করেন এবং সবচে’ বড় কথা তারা অন্যান্য ‘চিন্তাধারী’ মানুষগুলোর সব ‘চিন্তা’কে সমন্বয় করে একটি ‘লক্ষ্য’ নির্ধারণ করেন এবং সেই লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য কর্মপরিকল্পনা করেন। একজন নেতা হতে হলে আমাদেরকে শেষ চিন্তাধারী মানুষের তথা নীল টুপিধারী মানুষের দলেই থাকতে হবে! কারণ কোন কিছু করতে গেলে অবশ্যই তথ্য দরকার, সেটা প্রাসঙ্গিক কিনা তা ভাবা দরকার, আবেগ থাকা দরকার, কোন সমস্যা হবে কিনা তা পরিমাপ বা পর্যালোচনা করা দরকার, সেটা প্রয়োগে বা বাস্তবায়নে নতুনত্ব ও অভিনবত্ব প্রয়োগ করা দরকার, ইতিবাচক ও আশাবাদী থাকা দরকার, বিকল্প কিছু ব্যবস্থা করা দরকার এবং এসব বিষয়কে ‘সমন্বয়’ করার দক্ষতা ও সক্ষমতার অধিকারী হতে হবে, যা শেষ চিন্তাধারী মানুষের রয়েছে। এতে করে আমরা কাঙ্খিত লক্ষ্য পৌছুতে পারি, ফলাফল পরিমাপ করতে পারি! আমি প্রায়ই শুনি তরুণ অভিযোগ করে বলে রাষ্ট্র তার জন্য কি করেছে, সমাজ তার জন্য কি করেছে? আমি তো মনে করি, রাষ্ট্র বা সমাজ আমার জন্য কি করেছে সেটা না ভেবে প্রথমেই রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি আমাদের কর্তব্যগুলো পালন করি। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি আমার কর্তব্যগুলো পালন না করে কীভাবেই বা আমি রাষ্ট্র ও সমাজকে আমার জন্য কিছু করতে বলবো? বরং নিজের কর্তব্য পালনের পর আমার একটি অধিকারও তৈরি হবে রাষ্ট্র ও সমাজকে আমার প্রতি তার যে কর্তব্য রয়েছে সেটি পালন করতে বলা। আসুন আমরা তরুণশক্তিকে কাজে লাগাই। সমাজ ও রাষ্ট্রের সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখি।