মানিকগঞ্জে বৈচিত্র্য, আন্তঃনির্ভরশীলতা ও বহুত্ববাদী সমাজ বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত
মানিকগঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার
বৈচিত্র্য, আন্তঃনির্ভরশীলতা ও বহুত্ববাদী সমাজ বিষয়ক দুই দিন ব্যাপি প্রশিক্ষণ কর্মশালা গত ২০-২১ জুলাই বারসিক মানিকগঞ্জ রিসোর্স সেন্টারের আওতাধীন বারসিক সিংগাইর রিসোর্স সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্মশালায় বারসিক মানিকগঞ্জ কর্মএলাকার সকল ২৩ জন কর্মী অংশগ্রহণ করেন।কর্মশালায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বারসিক এর পরিচালক এবিএম তৌহিদুল আলম।
কর্মশারা ১ম দিনে অধিবেশনের শুরুতেই পারস্পরিক পরিচিতিতে প্রত্যেকেই তার নাম, পদবী এবং বারসিক’র কোন এলাকায় কি কি কাজ করে তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরে পরিচয় প্রদান করা হয়। পরিচয়ের মধ্য দিয়ে প্রত্যেকের নাম ও কাজের ক্ষেত্রে যে বৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এরপর প্রশিক্ষণের প্রত্যাশা নিরূপন করা হয়। অংশগ্রহণকারীরা মানব সমাজ কি, বৈচিত্র্য কেন জরুরি এর প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ, বৈচিত্র্যের সাথে আত্তীকরণের সম্পর্ক কী, জেন্ডার বৈচিত্র্যতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতা কী, আন্তঃনির্ভরশীলতার তত্ত্ব সম্পর্কিত ধারণা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও বহুত্ববাদী সমাজ, সমাজবদ্ধতা কি, বহুত্ববাদী সমাজ গড়বো কীভাবে, বহুত্ববাদী সমাজ নৈতিক মূল্যায়ন, বৈচিত্র্য এবং আন্তঃনির্ভরশীলতার সাথে সম্পর্ক কি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমাজের বিশ্লেষণ, সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ কীভাবে করা যায়? সামাজিক ঐক্য ও দ্বন্দ্ব সম্পর্কে ধারণা, আত্তীকরণ, বৈচিত্র্য এবং আত্তীকরণের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়গুলো তাদের প্রত্যাশায় তুলে ধরেন।
২য় অধিবেশনের শুরুতেই একটি গানের মাধ্যমে “রক্তশূন্য দেশ” সমাজ ও দেশের মধ্যে বিরাজমান নানা ধরণের বৈষম্য এবং বৈষম্য প্রতিরোধে ঐক্য গড়ে তোলার আহবান জানানো হয়। এরপর মানব সমাজ, সমাজবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা, মানব সমাজের বিকাশ সম্পর্কিত ধারণায়ন, সমাজে এক্য এবং দ্বন্দ্বের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করা হয়। যেখানে ৪৫০ কোটি বছর আগে থেকে শুরু করে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে কীভাবে মানুষ পৃথিবীতে বসবাস শুরু করলো এবং সমাজ কাঠামো তৈরি হলো, পৃথিবী কীভাবে তার আকৃতি লাভ করলো তা নিয়ে ভিডিও ডকুমেন্টরি দেখান এবং বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
৩য় অধিবেশনে মানুষের সাথে গাছপালা, পশুপাখি এবং প্রাণহীন পরিপার্শে^র সাথে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়। এখানে পরিবেশ, প্রতিবেশ নিয়ে আলোচনা করা হয়। গাছ-পালা, প্রাণ-প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ককে বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। আলোচনায় ৬টি মতবাদ তুলে ধরে আলোচনা করা হয়। ১. মানবতাবাদ/ মানুষ কেন্দ্রিক মতবাদ- যেখানে মানুষকে বড় করে দেখা হয়। ভাবা হয় মানুষই শ্রেষ্ঠ। ২. প্রতিবেশ নারীবাদ-এখানে পরিবেশ ও নারীকে একই সমার্থক ধরা হয়। নারীরা যেমন বিভিন্ন সমস্যা, নির্যাতন ও নানা ধরণের বৈষম্যের শিকার হয় তেমনি প্রকৃতিও নানা ধরণের বৈষম্য ও ধ্বংসের শিকার হয়ে থাকে বলে এখানে মনে করা হয়। ৩. প্রাণ কেন্দ্রিক মতবাদ- এখানে কোনো একক প্রাণকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে সকল প্রাণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়না। বস্তুত সবাইকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ৪.প্রাণির অধিকার ভিত্তিক মতবাদ-এ মতবাদ সমস্ত প্রাণির বেঁচে থাকার অধিকার আছে বলে মনে করে। ৫. প্রতিবেশ কেন্দ্রিক মতবাদ- এ মতবাদ পরিবেশের উপাদানগুলোর মধে যে সম্পর্ক আছে তাকে গুরুত্ব দেয়। ৬. তত্ত্বাবধায়ক মতবাদ- এ মতবাদে মানুষ প্রকৃতিকে নিজের অংশ মনে করে এবং তার সংরক্ষণ করে। নিজেদের তত্ত্বাবধায়ক মনে করে। সংরক্ষক মনে করে টেকসই ভোগ করে।
৪র্থ অধিবেশনে বৈচিত্র্য, বৈচিত্র্যের ধরণ ও বিভিন্ন ধরণের বৈচিত্র্য সম্পর্কিত ধারণায়ন, কেন বৈচিত্র্য প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। বলা হয় মানুষ সমাজ ও প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বৈচিত্র্য প্রয়োজন। বৈচিত্র্য সাধারণত: দুই ধরণের হয়ে থাকে। প্রাণগত বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। প্রাণ বৈচিত্র্যের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে যেমন প্রজাতিতে বৈচিত্র্য, পরিবেশগত বৈচিত্র্য এবং জিনগত বৈচিত্র্য। ভিডিও ডকুমেন্টরী প্রদর্শনের মাধ্যমে বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
৫ম অধিবেশনে আত্তীকরণ, বৈচিত্র্য এবং আত্তীকরণের সাথে সম্পর্ক, বৈচিত্র্য এবং আত্তীকরণ বিষয়ে বারসিক’র দর্শন ও কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। বলা হয় আত্তীকরণ একটি প্রক্রিয়া। উন্নয়ন কর্মকান্ডে সমস্ত মানুষকে সম্পৃক্ত করে মূল ধারায় যুক্ত করার প্রক্রিয়াই হলো আত্তীকরণ প্রক্রিয়া। আত্তীকরণের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যেমন- ১.সামাজিক আত্তীকরণ, সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ ও অর্থনৈতিক আত্তীকরণ। বারসিক’র আত্তীকরণের দর্শন ও প্রক্রিয়া- সামগ্রিক অর্থে জননেতৃত্বে উন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করে মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য কাজ করে। জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা আত্তীকরণের একটি প্রক্রিয়া। আন্তঃনির্ভরশীলতার সম্পর্ক স্বীকার করার কৌশল বারসিক’র একটি আত্তীকরণ প্রক্রিয়া।
২য় দিনের শুরুতে পূর্ব দিনের পর্যালোচনা করা হয়। পর্যালোচনা শেষে আন্তঃনির্ভরশীলতা, আমাদের জীবন যাত্রায় আন্তঃনির্ভরশীলতার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়। বলা হয় আন্তঃনির্ভরশীলতা হলো- একজন অন্যজনের সাথে, একজন বহুজনের সাথে, বহুজন একজনের সাথে, বহুজন বহুজনের সাথে কোনো না কোনোভাবে যে নির্ভরশীল তাই আন্ত:নির্ভরশীলতা। আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক বুঝানোর জন্য সুতা দিয়ে পানি, মাটি, পাখি, গাছ, মাছ, লাঙ্গল, মসলা, কুমার, তাঁতী, হাড়ি, তৈল ইত্যাদির যে সম্পর্ক তা বুঝিয়ে দেন। আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক মূলত; দায়বদ্ধতা ও দায়-দায়িত্ব তৈরি করে। নিজের অহমবোধ প্রশমিত করে। আন্তঃনির্ভরশীলতার বিভিন্ন ধরণের গুরুত্ব রয়েছে। যেমন- ১. সামাজিক গুরুত্ব, ২. অর্থনৈতিক গুরুত্ব, ৩. পরিবেশগত গুরুত্ব এবং ৪. সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। এরপর আন্তঃনির্ভরশীলতার বিভিন্ন সম্পর্ক যেমন- বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন প্রাণের মধ্যে প্রতিবেশীয় সম্পর্ক, পারস্পরিক সহযোগিতা সম্পর্ক, সহভোক্তার সম্পর্ক, পরজীবী পোষক সম্পর্ক, সিন্যাক্রোসিস সম্পর্ক, প্রতিযোগিতার সম্পর্ক, খাদ্য ও খাদক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে ডকুমেন্টরী প্রদর্শনের মাধ্যমে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
সবশেষে দলীয় অনুশীলনের মাধ্যমে বহুত্ববাদী সমাজ কী এবং বহুত্ববাদী সমাজ কেন প্রয়োজন সে বিষয়ে ৩টি দলে ভাগ হয়ে আলোচনা করা হয়। প্রথমে ১ নম্বর দল, ২ নম্বর দল এবং ৩ নম্বর দল এভাবে প্রত্যেক দল ব্রাউন পেপারে লিখিতভাবে উপস্থাপন করেন। এরপর একটি গানের মাধ্যমে বৈচিত্র্য, আন্ত:নির্ভরশীলতা এবং বহুত্ববাদী সমাজ এর পারস্পরিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। যেখানে মাছ দিয়ে সমাজের শাসক, শোষিত এবং নানা ধরণের বৈষম্য তুলে ধরা হয়।