হারিয়ে গেছে উপকূলের মাছবৈচিত্র্য

সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
‘একসময় আমাদের এলাকাতে নানান ধরনের মাছ পাওয়া যেতো। আর এসব মাছে ছিলো স্বাদে ভরপুর। আগে আমরা আমাদের এলাকার খাল, বিল, নদী ও পুকুর থেকে নানা ধরনের মাছ সংগ্রহ করতাম। তখন এসব উৎসগুলোতে এমন মাছ হতো যে একদিন মাছ ধরলে আর পাঁচদিন না ধরলে চলে যেতো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আর এখন মাছের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। আমরা যেখানে বাস করি তার চারিপাশে শুধু পানি আর পানি। সাধারণত এ পানিতে তো বিভিন্ন ধরনের মাছ হয়। কিন্তু এলাকার সব পানি এখন লবণ পানি। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন লবণ বাড়তেই আছে। এ লবণ পানি সম্প্রসারণের কারণে আমাদের মাছের বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। এখন শুধু লবণ পানির মাছ পাওয়া যায়।’
এমন কথাগুলো বলেন শ্যামনগর উপজেলার কল্যানপুর গ্রামের প্রবীন জেলে এন্তাজ সরদার। গতকাল বারসিক’র সহায়তায় কল্যাণপুর গ্রামে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সদস্যদের অংশগ্রহণ রফিকুল ইসলামের বাড়িতে লবণাক্ততা ও মাছ বৈচিত্র্য বিষয়ক গ্রাম পর্যায়ে এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথাগুলো বলেন।


আলোচনা সভায় জেলে সমিতির সদস্য ও কৃষক, কৃষাণী ও বারসিক কর্মকর্তাসহ ১০ জন নারী ও ১৯ জন পুরুষসহ মোট ২৯ জন অংশগ্রহণ করেন। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা জানান, আগে আমাদের এলাকায় মিষ্টি পানির শোল, কৈ, পুটি, বোয়াল, মাগুর, জেল, চ্যাং, নয়না, মরুল্য, বিভিন্ন ধরনের ট্যাংরা, লাটা, বেতলা, বাইন, তোড়া, রেখা, চান্দা, কাকশেল, চেলা, ছাটি, গদা, শিংসহ নানান ধরনের কাপ জাতীয় মাছ পাওয়া যেতো। এছাড়া লবন পানির মধ্যে ছিলো তাড়ে, ভেটকে, ভাঙাল, পাশের্^, দাতিনা, পায়রা, তেলাপিয়া, কাইন, রেখা, চরখোদা, মেইন, ইলিশ, চাকুল, টেপা, দুধে কামোট, চিতল, আমাদি, গাং খয়রা, বগী, ইলিশে খয়রা, গাং কৈ, মড়িচুনা, ফ্যাশা, লাল আমাদি, চিংড়ি, চামনে, গদা, হরিনা, রশনা, বাশপাতা, বিভিন্ন ধরনের গুলে, ভোদ বালে, কৈবোল, রুপচাদা, রুপপেটি, নিড়ে, ভাঙাল, কুচে, কাকড়াসহ নানান ধরনের মাছ মাছ পাওয়া যেতো।


তারা আরও জানান, এখন লবণ পানির অনেক মাছ থাকলেও মিষ্টি পানির মাছগুলো হারিয়ে গেছে। মিষ্টি পানির মাছ নেই বললেও চলে শুধুমাত্র বর্ষার সময় কিছু শোল ও কৈ মাছ দেখা যায়। এছাড়াও বোয়াল ও শিং মাছ এখন তাদের এলাকা থেকে একেবারে হারিয়ে গেছে। তারা এখন এলাকার খাল, পুকুর, ঘের ও নদী থেকে মাছ পেয়ে থাকেন। এই প্রসঙ্গে হাবু মোড়ল, শফিকুল ইসলাম, নুরজাহানরা বলেন, ‘এলাকা থেকে মিষ্টি পানির মাছ কমে গেছে। কারণ এলাকার সব পুকুর, খাল এর পানি লবণ এছাড়াও চিংড়ি যে ঘের আছে তাও তো লবণ পানি। এ লবণ পানির কারণে মিষ্টি পানির মাছগুলো হারিয়ে গেছে। মিষ্টি পানির আগের যেসব মাছ পাওয়া যেতো তা কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে হতো কোন রকম সার

কীটনাশক ও ব্যবহার করতাম না। যার কারণে স্বাদও খুবই ভালো ছিলো। এছাড়াও নদীতে যে লবণ পানির মাছ পাওয়া যায় তাও কিন্তু স্বাদে ভালো। কিন্তু বর্তমান সময়ে পুকুর, ঘের, ও খাল ইজারা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে নেট পাটা দিয়ে ঘিরে সার কীটনাশক দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে ফলে মাছের স্বাদ কমে যাচ্ছে। এখন তো আমরা মাছ খাই না কি খাই তা অনেক সময় বুঝতে পারিনা।’


তারা আরও বলেন, ‘আগে যেমন খাল, বিল, পুকুর ও নদীতে নানান ধরনের মাছ পাওয়া যেতো তেমনি বাজারে গেলেও বিভিন্ন ধরনের মাছ দেখা যেতো। যতো দিন যাচ্ছে আমাদের ছেলে মেয়েরা তো মাছের চেনা তো দূরের কথা মাছের নাম বললেও তারা বিশ্বাস করতে চায় না যে এরকম মাছ ছিলো। মাছের বৈচিত্র্য কমার প্রধান কারণ হলো লবণাক্ততা।’


রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মাছ সংরক্ষণের জন্য আমরা তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করি না। কারণ এখন তো এলাকা সব লবণ পানি তাই লবণ পানির মধ্যে যে মাছগুলো টিকে তাকতে পারে সেই সব মাছ এলাকাতে চাষ হচ্ছে।’

happy wheels 2

Comments