উপকূলের প্রতিটি ঘর হোক এক একটি বীজ ব্যাংক
সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
গত ২৫ জুলাই থেকে উপকূলীয় এলাকায় ভারী বৃষ্টি হওয়ার কারণে অন্যান্য উপকূলীয় এলাকার মতো সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে গ্রামের রাস্তাঘাট, বসতভিটা, পুকুর, সবজি ক্ষেত, বাড়ির উঠান, চিংড়ি ঘের, খাল, বিল, বীজতলা, গোযালঘর, রান্নাঘর পানিতে তলিয়ে যায়। পানিতে প্লাবিত হওয়ার কারণে কার কোন পুকুর, কোন ঘের তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। এলাকার মানুষ নানাভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তবে সব থেকে বড় ক্ষতির শিকার হয়েছেন কৃষকরা!
উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ করে শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ধান উৎপাদনের প্রধান মৌসুম হলো আমন মৌসুম। এই এলাকায় লবণাক্ততার মাত্রা বেশি। এলাকায় সুপেয় পানি সংকট থাকায় শুধুমাত্র বর্ষাকালীন আমন মৌসুমে কৃষকরা ধান চাষাবাদ বেশি করেন। অন্য সময়ে যাদের শুধুমাত্র সুপেয় পানির উৎস আছে তারা ধান চাষ করেন। সাধারণত জুন-জুলাই মাস হলো আমন মৌসুমের ধানের বীজতলা করার সময়। উপকূলীয় কৃষকরা সে অনুযায়ী চলতি মৌসুমে নিজেদের জমি প্রস্তুত করে বীজতলা করতে শুরু করেছেন। বীজতলায় ধান ফেলানো হয়ে গেছে। আর সেই সময়ে আঘাত হানে অতিবৃষ্টি। যে বৃষ্টিতে সব কিছুর সাথে কৃষকের ধানের বীজতলাও দীর্ঘদিন পানির নিচে তলিয়ে থাকে। কৃষক বাজার থেকে এবং নিজেদের সংরক্ষিত বীজ দিয়ে বীজতলা করেছিলেন। ভারী বৃষ্টির কারণে সেই বীজতলা নষ্ট হয়েছে। কৃষকরা পুনরায় নতুন করে আবার বীজতলা তৈরীর চেষ্টা করছেন। তবে বীজ সঙ্কটের কারণে তারা নানান বাধার সন্মূখীন হচ্ছেন। নিজেদেও সংরক্ষিত বীজ দিয়েই তো তারা প্রথম বীজতলা করেছেন। অন্যদিকে আবার বাজারেও বীজের চড়া মূল্য। কৃষকরা নানাভাবে বীজ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছেন যাতে পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথেই তারা নতুন করে বীজতলা করতে পারেন। বীজ সংকট মেকাবেলায উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন স্থানের কৃষকরা নিজেদের সংরক্ষিত বীজ এবং খাদ্যের জন্য সংরক্ষিত ধা কে সম্বল করেই পরস্পরকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/08/pic-3-1.jpg)
তেমনিভাবে বিভিন্ন গ্রামের মতো হায়বাতপুর সেবা কৃষক সংগঠনের সভাপতি শেখ সিরাজুল ইসলাম ও কাশিমাড়ি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের কৃষক সুরেন্দ্র নাথ মন্ডল উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কৃষকের মাঝে ধান বীজ সহায়তা করেন। তারা দুজনে শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি, জয়নগর, গোবিন্দপুর, আড়পাঙ্গাশিয়া, বুড়িগোয়ালিনী, কলবাড়ি, দুর্গাবাটি, দেবালয়, দেওল, হায়বাতপুর, যাদবপুর, কালমেঘা, নকিপুর, চিংড়াখালী, নোনাবিল, খাঁ পাড়া, গুমানতলী গ্রামের প্রায় ৭০ জন কৃষকের মাঝে বিআর ১০ ধান, ব্রিধান ৪৯, ব্রিধান ৮৬, ব্রিধান ৬৭, বীনা ১০ প্রায় ৫৫০ কেজি ধান বীজ সহায়তা করেছেন। যার মধ্যে হায়বাতপুর সেবা কৃষক সংগঠনের সভাপতি কৃষক শেখ সিরাজুল ইসলাম বিনা মূল্যে ব্রিধান ৪৯, ব্রিধান ৮৬, ব্রিধান ৬৭, বীনা ১০সহ প্রায় ৩০০ কেজি এবং সুরেন্দ্র নাথ মন্ডল ৫০ টাকা কেজি দরে ২৫০ কেজি বীজ সহায়তা করেন।
এ-প্রসঙ্গে বীজ সহায়তা কারী কৃষক সুরেন্দ্র নাথ মন্ডল বলেন, ‘আমি একজন ছোট কৃষক। আমার নিজের মাত্র ১ বিঘা জমি এবং বর্গা করি প্রায় ২ বিঘা জমিতে। প্রতিবছর আমি বিআর ১০ ধান লাগাই। আর এখান থেকে প্রতিবছর আমি আমার মতো বীজ রেখে দিই। অন্য ধান সারা বছরের খোরাকির জন্য রেখে দিই। এবছর যে বৃষ্টি হলো তা আমার বয়সে দেখিনি। এই বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে এলাকার সকলের মতো আমার আমনের বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে খাদ্যের জন্য যে ধান রেখেছিলাম তা আবার বীজতলা করি। খাওয়ার এ ধান রাখার সময় ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে রেখেছিলাম। যার জন্য ধানের কলা ভালো বের হয়েছে। আমার এ ধান দেখে আমাদের গ্রামের অনেকে নিয়ে যায়। আমার কাছ থেকে প্রায় ৩০ জন বি আর ১০ ধান নিয়ে গেছে। আমার এ খাবার ধান দিয়ে মানুষের একটু উপকার করতে পেরেছি এতেই আমার খুব ভালো লাগলো। এই যে বৃষ্টি দেখলাম এতে আমাদের সকলের সাবধান হওয়া উচিৎ। আমি আগামীতে আরো বেশি করে বীজ ধান রাখার চেষ্টা করবো। সকলের নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করা খুবি জরুরি।’
বীজ সহায়তা কারী অন্য কৃষক শেখ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সব সময় বীজ সংরক্ষণ রাখার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিই। এলাকার অনেকে বীজ রাখে আবার অনেকে রাখে না। আমরা যে এলাকায বাস করি এখানে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্গোগ লেগে আছে। তার সাথে মোকাবেলা করে আমরা টিকে আছি। এসব দুর্যোগ আমাদের নানান শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। এই ভারী বৃষ্টিতে আমাদের কৃষকদের বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। এতে করে কৃষক বীজ সংকটে পড়েছেন। এখান থেকে বের হতে হবে। আমাদের বীজ আমাদের রাখতে হবে। তার জন্য প্রতি ঘরে ঘরে যেমন বীজ ব্যাংক তৈরি করতে হবে। তেমনি ইউনিয়ন বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে বীজ ব্যাংক গড়ে তুলতে হবে। আমি প্রতিবছর বীজ সংরক্ষণ রাখি। এ বীজ সংরক্ষণে আমি প্রথমে বারসিক থেকে উৎসাহ পাই। পরবর্তীতে উপজেলা কৃষি অফিসও বীজ সংরক্ষণ রাখার জন্য বিভিন্ন পরামর্শ ও উপকরণ সহায়তা করে। সেই থেকে আমি বীজ সংরক্ষণে আগ্রহী হই। এবছর দুর্যোগের আগে যেমন কৃষকদের ধান বীজ সহায়তা করেছিলাম। আবার দুর্যোগকালীন সময়েও প্রায় ৪০ জন কৃষকের মাঝে ধান বীজ সহায়তা করতে পেরেছি।’
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2021/08/pic-1-2-1024x485.jpg)
বীজ গ্রহণ কারী কৃষক বিমল মন্ডল, ভান্ডু কয়াল, বিকাশ মন্ডল, সালাউদ্দীন, সতিশ মন্ডলরা জানান, তাদের এলাকায় ধানের প্রধান মৌসুম হলো এই আমন মৌসুম। সারা বছর তারা অপেক্ষায় থাকেন এই মৌসুমে ধান চাষ করার জন্য। এই সময় তারা নিজের জমি এবং অন্যের জমি বর্গা নিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ গ্রহণ করে ধান চাষ করেন। এবছর বর্ষা শুরু হলে জমি তৈরি করেন। কিন্তু অতিবৃষ্টিই তাদেও জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। তারা সিরাজুল ইসলাম ও সুরেন্দ্র মন্ডলের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করেন। এই্ দুর্যোগের সময় তাদের উপকারের কথা তারা কোনদিন ভুলবেন না বলে জানান।
দুর্যোগকালীন সময়ে বীজ সংকট সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষকরা যে পারস্পরিক এবং ন্যায্যমূল্যে বীজ সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা প্রশংসনীয়। এভাবে যদি প্রত্যেক কৃষক কৃষকের পাশে দাঁড়ান তাহলে সব রকমের দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।