মানিকগঞ্জের ভাষা সৈনিক কমরেড হাকিম মাস্টার
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের ভাষা সৈনিক কমরেড আঃ হাকিম মাস্টার। বর্তমানে তিনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকও। কিন্তু তারপরও ভাগ্যে জোটেনি কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। দারিদ্রের সাথে মিতালী পেতে করছেন মানবেতর জীবনযাপন।
৫২’র ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “মায়ের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিয়ে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী উর্দ্দুকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে এটা আমরা মেনে নিতে পারিনি। ১৯৪৮ সালের জিন্নাহ ঘোষণা দেওয়া থেকেই আমরা প্রতিবাদ করি। আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকি। সংস্কৃতির শহর মানিকগঞ্জ সবসময় ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল।
কর্মময় জীবনে কমরেড আঃ হাকিম মাস্টার তেরশ্রী কে.এন. ইনষ্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ৫২’র ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং ৯০’এর স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থেকে স্বক্রিয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। সেই সময় ১৯৪৯ সালে আঃ হাকিম মাস্টার তেরশ্রী কে.এন. ইনষ্টিটিউশনের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে যুক্ত হয়ে পড়েন ৫২’র ভাষা আন্দোলনে।
তেরশ্রী কে.এন. ইনষ্টিটিউশনের সহকারী শিক্ষক কমরেড প্রমোথ নাথ নন্দী এই আন্দোলন সংগঠিত করেন। প্রমোথ নাথ নন্দীর সাথে যুক্ত হয়ছিল একই বিদ্যালয়ের প্রয়াত ক্রীড়া শিক্ষক আফছার উদ্দিন আহমেদ। এদের দু’জনের প্রেরণায় আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হতে থাকে। “ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ” এর ব্যানারে মানিকগঞ্জে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠক। তৎসময়ে মানিকগঞ্জ জেলা কেন্দ্রিক ভাষা আন্দোলনের ব্যানারে যারা অংশগ্রহণ করেন তারা হলেনঃ সহকারী শিক্ষক প্রমোথ নাথ নন্দী, ক্রীড়া শিক্ষক প্রয়াত আফছার উদ্দিন, কলেজ শিক্ষার্থী প্রমোথ সরকার, ডা. মোবারক আলী, ডা. আঃ ছালাম, আব্দুল হাকিম মাষ্টার, আঃ রহমান ঠাকুর ছাত্র, ভূপেন দাস ছাত্র, ফনিন্দ্র নাথ সরকার ছাত্র, সিরাজ উদ্দিন মৃধা ছাত্র, মোঃ ওয়াজ উদ্দিন ছাত্র, মোঃ রেহাজ উদ্দিন ছাত্র।
উল্লেখিত আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকার হুলিয়া জারি করেন। সকল আন্দোলনকারী গ্রেফতার এড়িয়ে গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন ছাত্ররা। তবে দূঃখজনক হলেও সত্য উল্লেখিত ভাষা সৈনিকের সংগ্রামী কার্যকলাপের উপর মানিকগঞ্জ জেলায় পৃথক কোন স্মৃতি নেই। এমনকি সবার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজও মেলেনি।
ভাষা সৈনিক কমরেড আব্দুল হাকিম মাস্টারের সাথে আলাপ করলে তিনি দুঃখ করে বলেন, “ভাষার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, জেল খেটেছি, জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে দিনের পর দিন পালিয়ে থেকেছি। মায়ের ভাষার জন্য এ দেশের ছাত্ররা ঢাকা রাজপথে বুকে রক্ত ঢেলে দিয়েছে। এতোকিছুর পরেও ভাষার প্রতি চলছে চরম অবজ্ঞা।” তিনি আরও বলেন, “২১শে ফেরুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ায় বুকটা গর্বে ভরে গেছে। আবার দূঃখে কান্না আসে, আনন্দটা ম্লান হয়ে যায়। যখন দেখি আমাদের দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার এখনও যথার্থ প্রয়োগ নেই। সব বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে সর্বস্তরের বাংলা ভাষার ব্যবহার বাস্তবায়ন করা হোক।”
ঘিওর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল আজিজ বলেন, “কমরেড আব্দুল হাকিম মাস্টারকে অবিলম্বে ভাষা সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।” জেলা সি.পি.বি সভাপতি এ্যাডঃ আজাহারুল ইসলাম (আরজু) বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের অঙ্কুরোদগম ঘটে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। আমি ভাষা আন্দোলনে যারা অবদান রেখেছে তাদের সবাইকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।”