পলো বাওয়া উৎসব: একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতি
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
বাংলার গ্রামাঞ্চলের মাছ ধরার ঐতিহ্যবাহী উৎসবের নাম ‘পলো বাওয়া’ বা পলো উৎসব। বাঁশের তৈরি মাছ ধরার উপকরণ ‘পলো’ দিয়ে হাটু বা কোমড় পানিতে দল বেঁধে সারিবদ্ধভাবে মাছ ধরার সংস্কৃতিই পলো বাওয়া বা পলো উৎসব নামে পরিচিত। আজ ২২ অক্টোবর নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ডুবদইল বিল ও কান্দইল বিলে অনুষ্ঠিত হয়েছে নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার উৎসব ‘পলো বাওয়া’।
কাকডাকা ভোরে নেত্রকোনা ও পার্শ¦বর্তী জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিভিন্ন বয়সের সহ¯্রাধিক মাছ শিকারী অটো রিক্সা, পিকআপ ভ্যান, সাইকেল, রিক্স, মটরসাইকেল করে আবার কেউ কেউ পায়ে হেটে বিভিন্ন আকারের বাঁশের পলো, ছিপ জাল, খেওয়া জাল, কইন্যা জাল (থৌরা জাল) নিয়ে ডুবদইল বিল ও কান্দইল বিলে উপস্থিত হয়। সকাল ৭টা থেকে প্রায় সহ¯্রাধিক মাছ শিকারীরা দুই বিলের দুই পাশ থেকে পানিতে নেমে সারিবদ্ধভাবে নিজ নিজ পলো দিয়ে মাছ ধরতে ধরতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আরেকটি দল ছিপ জাল, কইন্যা জাল ও খেওয়া জাল নিয়ে পলো থেকে ছুটে যাওয়া মাছগুলো ধরতে পলো শিকারীদের সারিবদ্ধভাবে অনুসরণ করে। মাছ শিকারীরা পলো বাওয়ার সময় যখন জোরে জোরে চিৎকার করে উল্লাস করে তখন পুরো বিলে একটি আন্দময় আমেজ তৈরি হয়।
যেসব শিকারীদের পলোতে ও জালে বড় মাছ ধরা পড়ে তখন তারা যেমন উল্লাস করে, তাদের মাছ দেখে অন্যরাও মাছ পাওয়ার আশায় চিৎকার করে উল্লাস করে। কিন্তু ডুবদইল বিল এবং কান্দইল বিলে এ বছর প্রচুর জার্মুনি পানা ও পানি বেশি থাকায় মাছ শিকারীরা সঠিকভাবে পলো বাইতে না পারায় তেমন মাছ ধরতে পারেননি বলে পলো শিকারীরা জানায়। সরেজমিনে দেখা যায়, মাছ শিকারীদের অধিকাংশই মাছ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যা”েনছ। আবার কারো কারো হাতে ছোট ছোট শোল মাছ দেখা গেছে। বিগত বছরে পলো দিয়ে শিকারীরা এই দুই বিল থেকে যে পরিমাণে বড় বড় মাছ ধরেছিলেন তার বিশ ভাগ মাছও তারা এ মৌসুমে ধরতে পারেননি বলে জানান। পানি বেশি হওয়ায় এবং জার্মুনি পানা বেশি থাকায় পলো বাইতে না পারায় বিলে অনেক মাছ থাকলেও পলেতে বা জালে মাছ ধরা পড়েনি। তবে পানি আরো কমে গেলে অনেক মাছ পাওয়া যাবে বলে মাছ শিকারীরা জানান।
পলো বাওয়া উৎবে মাছ শিকারীরা যেসব উপকরণ ব্যবহার করেছেন তার সবগুলোই মাছ ধরার স্থানীয় উপকরণ। পলো বাওয়া উৎসব ভাটি অঞ্চলে আজও টিকে থাকায় মাছ ধরার স্থানীয় উপকরণগুলো এবং এর সাথে সম্পৃক্ত বাঙালির সংস্কৃতিও টিকে আছে যুগ যুগ ধরে। পলো বাওয়া উৎসব যেন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মাছ শিকারীদের ক্ষণিকের মিলন মেলা। পলো শিকারীরা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে কখন কোন বিলে বা জলাশয়ে পলো বাওয়া হবে তার দিনক্ষণ ঠিক করে সকলকে জানিয়ে দেয়। নির্ধারিত দিনে কাকডাকা ভোরে সকল পলেঅ শিকারীরা নির্ধারিত বিলে বা জলাশয়ে উপস্থিত হয় এবং সূর্য উঠার সাথে সাথে পানিতে নেমে যায়। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া উৎসবটি যেন পারস্পারিক সম্পর্ককে শক্ত বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। তবে যেভাবে জলাশয়গুলো ভরাট করে আধুনিক শহর গড়ে উঠছে তাতে এ ধরণের উপকরণ ও সংস্কৃতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে একদিন হয়তো স্থান হবে দেশের লোক সংস্কৃতি যাদুঘরে।