মগড়া নদী রক্ষায় নবজাগরণ
মো. আলমগীর, বারসিক নেত্রকোনা রিসোর্স সেন্টার, নেত্রকোনা
ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি পানির অপর নাম জীবন। যাদের কাছে শুনেছি তারাও শুনেছে তাদের পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে। ছোট বেলায় বিষয়টি বুঝতাম না, পানি কি এমন গুরুত্বপুর্ণ উপাদান যা জীবনের সমতুল্য। আমাদের চারপাশে শুধু পানি আর পানি, নদীতে পানি, পুকুরে পানি, খালে পানি, নালায় পানি, ডোবাই পানি, জমিতে পানি। বাংলাদেশ তো পানির-ই দেশ। আমাদের চারপাশের এত সহজলভ্য উপাদানকে যখন জীবনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমার্থক শব্দ হিসেবে বলা হতো তখন প্রায়ই খটকা লাগতো। আস্তে আস্তে বড় হই, লেখাপড়া করার সুযোগ হয়, দৈনন্দিন জীবনে পানির ব্যবহার থেকে ধারণা পাই যে, কেন পানির অপর নাম জীবন বলা হয়। তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পানির গুরুত্ব ও পানি ছাড়া যে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না সেই বিষয়ে আমার উপলব্ধি হয় আরও পরে। জীবন-জীবিকার তাগিদে আজ থেকে ১৫ বছর আগে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনে কাজ শুরু করি। নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলায় ঋণ কার্যক্রমে পরিচালনার ক্ষেত্রে সমিতিতে ঋণ দেওয়া ও নিয়মিত কিস্তি তোলার জন্য যেতে হত বিভিন্ন গ্রামে। নেত্রকোণায় যে দিন প্রথম আসি সেই দিনই মগড়া নদীর নাম শুনতে পাই। আটপাড়া উপজেলাটি মগড়া নদী দ্বারা বেষ্টিত।
বিভিন্ন গ্রামে যাতায়াতের সময় মাঝেমধ্যে নৌকা ও বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার করতে হতো। সেই সময় আমার প্রায়ই মনে হত কেন নদীর উপর একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয় না। কেননা সাইকেল নিয়ে বাঁশের সাকো দিয়ে নদী পারাপার সত্যি খুব কষ্টকর ছিলো। একদিন মগড়া নদী পাড় হয়ে মুনসুরপুর জেলে পাড়ায় কিস্তি আনতে যাই। সেদিন দুই জন সদস্য কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারছিল না। তাদের অনেক বকাঝকা করি। তারপর জানতে পারি এই পরিবারগুলো নদী থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে তারা নদীতে সেভাবে মাছ পাচ্ছেন না। ফলে জেলে পরিবারগুলোর আয় রোজগার না থাকায় নিয়মিতভাবে কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। নদীতে মাছ না পাওয়ার কারণ হিসেবে নদীর সাথে হাওরের সংযোগ খালের মুখে একটি বাঁধ নির্মাণ। ফলে নদীতে আর মাছ আসছে না; নদীতে আর আগের মত মাছ পওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে এসব জেলে পরিবারগুলোর পক্ষে ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ তো দূরের কথা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারও জুটছে না তাদের কপালে। কথা শুনে আমার মাথায় খটকা লেগে যায়। আমি তো নিজেই এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থাকে উন্নয়নের জন্য মনে মনে এই নদীতে বাঁধ নির্মাণের জন্য কত না যুক্তি খুঁজে বেড়িয়েছি। কিন্তু একটি বাঁধ বা অপরিকল্পিত অবকাঠামো এক শ্রেণীর মানুষের জীবনে কতটা দুর্দশা বয়ে নিয়ে আসে তা এই জেলেপাড়ার অর্ধাহারি অনাহারি মানুষগুলো যেন আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। আমার চোখে যা উন্নয়ন তা যে অসংখ্য মানুষকে পেশাহীন করে তুলতে পারে, মানুষের খাবার কেড়ে নিতে পারে তা তো কখনও ভাবিনি। আমি কোন কিছু কখনই গভীরভাবে ভাবতে পরিনা। এরপরও বিষয়টি নিয়ে কেন জানি খারাপ লাগছিল। অনেকের বিলাসিতার জন্য তৈরি একটি বাঁধ সমাজের পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন পেশার মানুষগুলোকে আরও যে কত পিছিয়ে দিতে পারে তার শেষ নেই। কিন্তু এরকম অপরিকল্পিত বাঁধ তো প্রতিয়িতই হচ্ছে।
একদিন একটি গ্রামীণ বীজ মেলায় বারসিক’র একজন গবেষকের সাথে দেখা হয়, কথা হয়, খুব কম সময়ের মধ্যেই আমি আশান্বিত হই, মনে হচ্ছিল এই মানুষটাই হয়তো সমাজের সেই কিস্তি পরিশোধ না দিতে পারা মানুষগুলোর জন্য ‘সহায়ক’ হিসেবে আর্বিভূত হতে পারে। তার আমন্ত্রণে একদিন অভয়পাশা লার্নিং সেন্টারে যাই, সেখানে প্রাণবৈচিত্র্যের অনেক পোস্টার চোখে পড়ে। তার মধ্যে পানি নীতি, পানি অধিকার, পানি আইন, পানি ইস্যু, পানি সংকট, পানি ও নারী ইত্যাদি পানি কেন্দ্রিক পোস্টারও ছিল। তারপর আমার কাজের অবসর সময় আমি তার সাথেই কাটাই, তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি, তাদের কার্যক্রমগুলো আমার খুবই ভালো লাগে। একসময় আমারও সুযোগ হয় তাদের সাথে কাজ করার।
নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অবস্থা জানার জন্য মগড়াপাড়ের মানুষদের জানার চেষ্টা করি। নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের মগড়া নদীর পাড়ে জেলে পাড়ায় ১৩টি হিন্দু বর্মণ পরিবার বসবাস করে। তাদের বাড়িতে যাওয়া আসার মধ্য দিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিভিন্ন সময় তাদের জল, জলাশয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে কথা হয়। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে এ পাড়ার একজন প্রবীণ জেলে বাবু অতুল চন্দ্র বর্মণ বলেন, “আগে প্রাকৃতিক জলাশয়ে জেলেদের পূর্ণ অধিকার ছিল, জেলেরা নদীতে মাছ ধরত, বিক্রি করত, হিদল দিত, শুটকি দিত, তাদের জীবনে সুখ ছিল। মাছের তেল দিয়ে বাতি জ্বালাত, পিঠা ভাজত, মাছ ভাজত, বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানাদি করত।” তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে জেলেদের বৈচিত্র্যময় জীবন সংকটাপন্ন, অমৎস্যজীবীদের দৌরাত্ম্য, দখল, দাপটে নদী, খাল, বিল, জলাশয়ে জেলেদের কোন অধিকার নেই।” তিনি জানান নেত্রকোণার বিভিন্ন খালে, বিলে, নদীতে হাওড়ে ১২৫ থেকে ১৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে তার মধ্যে ৫০ থেকে ৫৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়েছে এবং অন্যান্য প্রজাতির মাছগুলোও পরিমাণে খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে। মাছ কমে যাওয়ায় এবং প্রভাবশালীদের দাপটে বর্তমানে জেলেরা জলমহাল থেকে বিতাড়িত হয়ে, পেশা হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। পাশাপাশি হারিয়ে যেতে বসেছে মৎস্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আলোচনায় তিনি বোঝাতে চেয়েছেন আসলে নদী কি? নদী না থাকলে কি ধরণের সমস্যা হয়। এই নদীর সাথে শুধু জেলে পরিবারগুলোই জড়িত নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকল পেশার মানুষই জড়িত, জড়িত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য। এই নদীকে বাঁচাতে না পারলে মানুষ হয়ে পড়বে পেশাহীন, বিলুপ্তি হবে প্রাণবৈচিত্র্য, ব্যাহত হবে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন।
এদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা যাই বলি না কেন এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে নদী, জল ও জলাশয়। একসময় নেত্রকোণা জেলায় ছিল ৫৭টি নদী। অধিকাংশ নদীই আজ বিলুপ্ত ও বিলুপ্তির পথে। এক সময়ের খড়স্রোতা মগড়া নদী আজ মৃত প্রায়। মগড়া নদীর উৎপত্তি স্থল নেত্রকোণার পূর্বধলার ধলাই খাল থেকে এবং গন্তব্য স্থল খালিয়াজুরি দিয়ে প্রবাহিত ধনু নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। এই ৮৫ কিলোমিটার নদীর পাড়ে ১৪৩টি গ্রাম অবস্থিত। নদী পাড়ের বিভিন্ন গ্রামের মানুষদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই মগড়া নদী শুধু একটি নদীই না, সভ্য জাতির স্থায়িত্বশীল জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। জেলে নদী থেকে মাছ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে যেমন সংসার চালান, তেমনি অন্য একজন দরিদ্র মানুষ শাপলা, শালুক সংগ্রহ করে পরিবারের খাদ্য যোগান দেয়, বাঁশের চালি, কাঠ ব্যবসায়ী, নৌকা চালক, খেয়ার মাঝি, স’মিল ব্যবসায়ী ও বড়শি শিকারীসহ কতইনা মানুষের কর্মস্থল ছিল এই নদী। কৃষক তার গরু গোসল করাতে যেমন ব্যবহার করতেন এই নদীর পানি, তেমনি ফসলের জন্যও এই নদীর পানিই ছিল অপরিহার্য। নারীর জীবনে, গৃহস্থালির কাজে পানি ব্যবহার নিয়ে যদি একটু ভাবি তাহলে এই মগড়া যে কি তা কি আর বুঝতে বাকি থাকে?
স্বরমুশিয়া জেলে পাড়ায় ১৩টি জেলে পরিবারের সাথে একক আলোচনা, দলীয় আলোচনা, বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান, পানি অধিকার ইত্যাদি বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হয়। এক পর্যায়ে তারা তাদের অস্তিত্ব রক্ষা/অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৩টি পরিবার নিজেদের প্রয়োজনেই নিজেরা সংগঠিত হয়ে ২০০৫ সালে গড়ে তুলেছেন জানমা (জা-জাল, ন-নদী, মা-মাছ) নামে একটি পেশাজীবী সংগঠন। সংগঠনের কার্যক্রম হিসেবে তারা গঙ্গাপুজা উৎসব উদযাপন করেন। অনুষ্ঠানে এলাকার কৃষক, ছাত্র, শিক্ষক ও ব্যবসায়ীসহ সকল পেশার মানুষ সমবেত হয়। অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক মাছ সংরক্ষণ ও বর্ধণের বিষয়ে সকলে অবগত হন, পুজায় ব্যবহৃত ধান ও ফল নিয়েও মানুষের মধ্যে আলোচনা হয়। আলোচকদের ভাষায় ফুটে উঠে গঙ্গা পুজা উদযাপনের মধ্য দিয়ে মাছ সংরক্ষণ ও বর্ধণের পাশাপাশি নির্ধারিত ধান ও ফল টিকে থাকবে। মাছ কেন্দ্রিক এই গঙ্গা পুজা না করলে মুছে যেতে পারে তালিকা থেকে নির্ধারিত এই ধান ও ফলের নামগুলো। ১৩টি পরিবারের ২৫ সদস্য বিশিষ্ট এই জানমা সংগঠনের কার্যক্রম দেখে পার্শ্ববর্তী গ্রামের ২৭টি জেলে পরিবার উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছেন জানমা বানিয়াজান মৎস্যজীবী সংগঠন। এভাবে আটপাড়া উপজেলায় মগড়া নদীর পাড়ে বসবাস রত ৩৭৬টি জেলে পরিবারই উদ্বুদ্ধ হয়। মগড়া পাড়ের সকল জেলেরাই মনে করেন, জানমা’র সদস্যদের যে সমস্যা তাদেরও একই সমস্যা। সকলেই এ্ই নদীর মাছের উপর নির্ভরশীল। তাই জেলেদের সমন্বয়ের মাধ্যমে পরামর্শে ও সহযোগিতায় একে একে গড়ে উঠে ১১টি প্রকৃত মৎস্যজীবী সংগঠন এবং ১১টি সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে উঠে জানমা উপজেলা মৎস্যজীবী সংগঠন। এই সংগঠনটি এখন এই উপজেলার জেলেদের অধিকার আদায়ের ঐক্যের প্রতীক। তারা নদী পাড়ের ভূক্তভোগীসহ সকল পেশাজীবী মানুষদের সাথে ঐক্য তৈরির মাধ্যমে নদী রক্ষার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, সাংবাদিক সম্মেলন, স্মারকলিপি প্রদান ও প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন। যার ফলে কালমগড়াসহ ৮টি জলমহাল তাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। নতুন প্রজন্মকে নদী রক্ষার দায়িত্ব হস্তান্তর, মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি ও বর্তমানে মগড়ার সার্বিক অবস্থার তথ্যগুলো নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে পৌছানোর লক্ষ্যে আয়োজন করেন মগড়া নদী উৎসব ২০১৪। উৎসবে বারসিকসহ দেশের ৩৬টি সংগঠন ্একাত্মতা প্রকাশ করে। উৎপত্তি স্থল পূর্বধলার ত্রিমোনীর ধলাইখালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ তাদের প্রিয় নদী ফিরে পাওয়ার দাবি নিয়ে অনুষ্ঠানে স্থলে চলে আসেন এবং আত্মচিৎকার করে বলেন, “এই মগড়ানদী আমাদের মা, আমার মাকে বাঁচান”। এইভাবে গন্তব্য থেকেও উদ্বোধন করার পর দুইদিক থেকে শত শত মানুষ নৌকা নিয়ে নেত্রকোনা সদরে কচিকাচা স্কুলের মাঠে মূল উৎসবে সমবেত হন। প্রবীণদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, নদীর প্রতি ঋণস্বীকার, প্রচার পত্রবিলি, নদী বিষয়ক স্মৃতিচারণ, প্রদর্শনী, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুধু অংশগ্রহণকারীরাই নন দেখতে আসা সবার কন্ঠে একটি ধ্বনিই প্রতিধ্বনিত হয় “আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই মগড়া নদীকে বাঁচাতে হবে”। জানমা উপজেলা কমিটির সভাপতি যোগেস চন্দ্র দাস বলেন, “এই মগড়া না বাঁচলে জানমা থাকবে না। ভেঙে পড়বে কৃষি, সংস্কৃতি ও জীবন জীবিকা। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে সকল পেশার মানুষের মধ্যে মগড়া নদী রক্ষার গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। এই অঞ্চলের বিভিন্ন ক্লাব, জনউন্নয়ন কেন্দ্র, জনউন্নয়ন পাঠাগারে সকল পেশার মানুষের মধ্যে নদী, জল ও জলাশয় রক্ষার বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকায় মগড়া রক্ষা, পানি রক্ষা, মাছ রক্ষা এবং মানুষের পেশা রক্ষার তাগিদ নিয়ে টেকসই উন্নয়নের জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মগড়া পাড়ের মানুষেরা উদ্যোগী হয়ে নেত্রকোণার পূর্বধলার ত্রিমোহনীতে মগড়া নদীর তলদেশে বিশ্ব পানি দিবস -১৫ উদযাপন করেন। এতে ১০/১২টি গ্রামের নারী পুরুষসহ সকল বয়সের হাজার হাজার মানুষ খালি কলস ও বালতি নিয়ে চলে আসেন মগড়ার তলদেশে। স্লুইচ গেইটের নিচে একটি ডোবার চারপাশে গোল হয়ে সকলে দাঁড়িয়ে হাত তুলে “পানি বন্ধন”র মধ্য দিয়ে তারা স্লোগানে উচ্চারণ করে, “আমাদের নদী, আমাদের সভ্যতা, আসুন নদী বাঁচাই, পানি বাঁচাই, পানিই জীবন পানিই মরণ, বাঁচাও পানি বাঁচাও জীবন”।
এই “পানি বন্ধন”র মধ্য দিয়ে পানি দিবসের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। তারপর সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বক্তারা এই নদীতে বারোমাস পানি না থাকলে মগড়াপাড়ের মানুষের পেশা ও প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত হবে, উপার্জনশীল মানুষ কর্মহীন হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা আরও বলেন “মানুষের মধ্যকার সহযোগিতার হাত ক্রমশই খাটো হয়ে আসছে, হ্রাস পাচ্ছে সু-সম্পর্কের বন্ধনও। জীবনধারণে পানির কোন বিকল্প নেই। স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে আমাদের হারিয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলো পুনঃরুদ্ধার করা জরুরি, নদী বিলুপ্তি হওয়া মানে মানুষ পেশাহীন হয়ে পড়া। জেলেরা আজ মাছ পাচ্ছে না, পেশা হারিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। নদীতে মাছ না থাকায় মানুষ বাজার নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। মগড়াকে রক্ষা করতে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।” তারা বলেন, “যারা নদী, জল, জলাশয়ের সাথে যুক্ত তাদের হাতে যদি নদী রক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে নদী রক্ষার জন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোন প্রকল্পই গ্রহণ করতে হবে না।”
যে সব সাংবাদিক, লেখক এই অঞ্চলে জন্মেছেন তাদেরও প্রাণের দাবি মগড়া নদীকে বাঁচানো। এই দাবিটা তারা করেছেন সাংবাদিক কিংবা লেখক হিসেবে নয়, বরং মগড়া ব্যষ্টিত নেত্রকোনার একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই। তারা বলেন, “এই নদী হচ্ছে আমাদের সবার মা, আমাদের মাকে বাঁচাতে হবে। এই নদী বাঁচলে নদীমাতৃক বাংলাদেশও বাঁচবে, বাঁচবে অসংখ্য প্রাণ।” নেত্রকোনার সাধারণ জনগোষ্ঠীর নদী রক্ষার দাবি-দাওয়া এবং ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানগুলো দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, জনসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আশা করছি এই সব কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মগড়া নদীতে আবার পানির প্রবাহে ফিরে আসবে, ফিরে আসবে প্রাণচাঞ্চল্য। জেলেরা নদীতে মাছ ধরবে, মাছ রক্ষা করবে, জমিতে ফসল হবে, কৃষককে হাঁসাবে এবং সর্বোপরি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা এবং প্রাণবৈচিত্র্যও সুরক্ষিত হবে। আমরা সবাই যে যেখানেই আছি, সেখান থেকেই যদি সাধারণ মানুষগুলোর সময়োপযোগী ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ জানার চেষ্টা করি, তাদের এই উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিই, তাহলে হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশের স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন সাধিত হবে, টিকে থাকবে প্রাণবৈচিত্র্য, সুরক্ষিত হবে পরিবেশ ও মানুষের অধিকার, যা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি।