প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণই আকাশের একমাত্র শখ

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
একজন মানুষ যখন আস্তে আস্তে বড় হয়, সেই সাথে তার চাওয়া পাওয়া বা ইচ্ছেগুলোও বাড়তে থাকে। সেই ইচ্ছে বা শখ পূরণের জন্য কেউ সুযোগ পায় আবার কেউবা সুযোগ তৈরি করে। এমনই একজন যুবক লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের বাইশদার গ্রামের আকাশ চন্দ্র দেবরায়। সে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের বাড়ির আঙিনাটিকে সাজিয়ে তুলেছে একটি বৈচিত্র্যময় বাড়ি হিসেবে।


সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম তার। ছোটবেলায় বাবার সাথে কৃষি জমিতে যেতো। সেখানে গিয়ে জমিতে নিড়ানি দেয়া, হাল চাষে সহযোগিতা করা ও ফসলের পরিচর্যাসহ নানা কাজে বাবার সাথেই সময় কাটাতো সে। তার বাবা যখন কোনো গাছের চারা রোপণ করতেন, সে গর্তে মাটি ভরাট করে দিত। কোন গাছটা কোন দিকে লাগাবে, খুঁটি দিতে হবে কিনা সব বিষয়ে বাবাকে পরামর্শ দিতো। এইভাবেই তার কৃষি কাজের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। সেই আগ্রহ এখন শখে পরিণত হয়েছে।


ছোটবেলায় যখন কোনো গাছ রোপণের ইচ্ছে হতো তখন বাবার কাছে আবদার করে টাকা চেয়ে নিতো। সেই টাকা জমিয়ে রেখে গাছের চারা কিনে এনে বাড়িতে রোপণ করতো। কিন্তু এখন তার পড়ালেখারও খরচ বেড়েছে, সেই টাকা বাবাকেই দিতে হয়। তাই বাবার কাছে বাড়তি টাকা চাইতে পারেনা। কিন্তু গাছ কেনার জন্য তো তার টাকার প্রয়োজন। তাই আকাশ বাড়ির আশেপাশের পতিত জায়গায় বিভিন্ন সময়ে মরিচ, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন ইত্যাদি চাষ করে। এই সব্জী বিক্রির টাকা দিয়ে সে তার পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন ফুল, ফলজ, ঔষধি গাছের চারা কিনে নিজের বাড়ির আঙিনায় রোপণ করে।


বর্তমানে তার বাড়িতে হাড়িভাঙ্গা, কাঠিমন, কিউজাই, আম্রপলি, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও স্থানীয়সহ প্রায় ১০ প্রজাতির আম গাছ আছে। এছাড়া মাল্টা, চায়না কমলা, দেশি কমলা, কাঠবাদাম, পেঁয়ারা, সাগরকলা, সবরিকলা, লিচু, বেল, জলপাই, কদবেল, তাল, আমড়া, আতাফল, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, নারিকেল, বড়ই, কাঁঠাল, জাম, এলাচি লেবু, বারোমাসী লেবু ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় ফলজ গাছ রয়েছে।


বাড়ির আঙিনার চারদিকে প্রায় ৫০টি’র মতো সুপারি গাছের চারা রোপণ করেছে। আরো আছে পেঁপে, সাজনা, দেশি নিম, হরিতকি, বহেরা, আমলকি, অর্জুন ইত্যাদি। পুকুরের একপাশে রোপণ করেছে পাম ট্রি। অন্য পাশে বারোমাসী লেবুর চারা। পুকুর পাড়ে যে বড় সাজনা গাছটি রয়েছে, সেটির ডাল কেটে কেটে রাস্তার দুপাশে রোপণ করেছিল। সে গাছগুলোতে এখন সাজনা ধরছে।


বেলী, কামিনী, সন্ধ্যামালতী, চন্দ্রমল্লিকা, বিভিন্ন রঙের জবা, রঙ্গন, টগর, কাঠমালতী ইত্যাদি ফুলের গাছ লাগিয়েছে বাড়ির ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়।
যেখানেই নতুন কোনো গাছের সন্ধান পায়, সেখানেই ছুটে যায় সেটি সংগ্রহ করতে। এভাবেই সে নিজের সংগ্রহশালার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। নিজের আগ্রহে গাছের বিভিন্ন কলম পদ্ধতি শিখেছে। বড় কোনো গাছ থেকে শাখা কলম পদ্ধতিতে চারা তৈরী করে বাড়ির আঙিনার বিভিন্ন পাশে রোপণ করেছে।


শুধু তাই নয়, বারোমাসী মরিচ ও বেগুনের চারা তৈরী করে নিজের বাড়িতে রোপণের পাশাপাশি প্রতিবেশিদের মাঝেও বিতরণ করে। এছাড়া গ্রামের রাস্তার দুইপাশে, মন্দিরের আঙিনায় সে নিজ উদ্যোগে ঔষধি গাছের চারা রোপণ করেছে। নিজের বাড়ি ও গ্রামের অনেকের বাড়ি থেকে তালবীজ সংগ্রহ করে চারা তৈরী করছে, যাতে গ্রামের বিভিন্ন রাস্তায় রোপণ করতে পারে।


নিজের বাড়ির আঙিনায় উৎপাদিত ফল সে নিজের হাতে প্রতিবেশিদের মাঝে বিতরণ করে। এছাড়া এই গ্রামে তার সমবয়সীদেরকেও এসমস্ত কাজে উৎসাহিত করে। তার এধরণের কার্যক্রম দেখে প্রতিবেশি পিন্টু সরকারও নিজ আঙিনায় বিভিন্ন গাছ রোপণ করতে শুরু করেছে। গ্রামের অনেকেই তার কাছে বাগান সংক্রান্ত বিভিন্ন পরামর্শ নিতে আসে।


পড়াশানার সময় বাদ দিয়ে আকাশ যতটুকু সময় পায়, সবটুকু সময় সে তার গাছপালার পরিচর্যা করে কাটায়। এছাড়া গ্রামের যে কোনো পরিবারের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা, সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করেও তার সময় কাটে। ভবিষ্যতে তার বাড়ির আঙিনায় আরো বিভিন্ন প্রকার গাছ লাগিয়ে এর পরিধি বাড়াতে চায়। তাছাড়া স্থানীয় জাতের মুরগির খামার করার ইচ্ছাও রয়েছে।


বর্তমানে আকাশ বি.এ শ্রেণিতে পড়ছে। এর পাশাপাশি কম্পিউটার শেখার উপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। স্থানীয় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করছে।
নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির সব ধরণের উপকরণ রয়েছে তার আঙিনায়। চলমান অস্থিরতার যুগে অনেক যুবক যেখানে বিভিন্ন অসামাজিক, অনৈতিক কাজে যুক্ত হয়ে সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আকাশ শুধুমাত্র নিজের আগ্রহে পরিবেশসম্মত চর্চায় যুক্ত রয়েছে। আকাশের মতো উদ্যমী মনোভাব আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই আছে। কেউ লালন করে, কেউ ধ্বংস করে। কেউ ইচ্ছাশক্তির জোড়ে বহুদূর এগিয়ে যায়। এই বহুদূর এগিয়ে যাওয়া’রাই আমাদের আগামী পৃথিবীর উন্মুক্ত বিচরণক্ষেত্র।

happy wheels 2

Comments