তাপদাহে পুড়ছে মানুৃষ পুড়ছে মাঠের ফসল

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
বৈশাখে প্রকৃতি রুক্ষ রূপ ধারণ করা নতুন ঘটনা নয়। প্রতিবছর বৈশাখে প্রথম সপ্তাহ থেকে আকাশের রূপ বদলায়। যে কোন সময় ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে। বৈশাখে ঝড় হবে, বৃষ্টি হবে এটাই একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এ বছর সব কিছু বদলে গেছে। প্রচন্ড গরমে অসহ্য হয়ে পড়ছে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি এলাকার মানুষ। শহরের মানুষগুলো চার দেয়ালে বন্দী। পাখির মতো ছটপট করে দম বন্ধ গরমে পাখার বাতাসের নিচে। তার উপর চলছে লোডশেডিং, খাবার পানির সমস্যা। টিউবওয়েলগুলোতে পানি উঠছেনা। এরই মধ্যে নি¤œ আয়ের মানুষগুলো তাপদাহ উপেক্ষা করে জীবনের প্রয়োজনে রাস্তায়, মাঠে, ঘাটে কাজ করে যাচ্ছে।


নেত্রকোনার বিশ্বনাথপুর গ্রামের শুরুতে প্রবীণ কৃষক আব্দুল কাদের (৬৫)। গরমে আব্দুল কাদিরের ৮টি মুরগি একরাতে মরে গেছে। রাতে হঠ্যাৎ মুরগিগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে মরে যায়। কাদির মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা বেগমের মন খুব খারাপ। অনেক কষ্ট করে টাকা সঞ্চয় করে ২টা মুরগি কিনে পালন শুরু করেছিলেন যা বেড়ে বর্তমানে ৮টিতে হয়েছে। আব্দুল কাদিরের মতো গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এখই অবস্থা। গ্রামের প্রায় শতাধিক হাঁস মুরগি মরে গেছে।
বাংলাদেশের প্রথমবারের মতো এত বেশি তাপদাহ প্রাণ ও প্রকৃতির উপর কেমন প্রভাব পড়েছে এ তথ্য নিতে গিয়ে কাদির মিয়ার বাড়ি হয়ে কৃষাণী মর্জিনার বাড়িতে যাই। মর্জিনার ছেলে গরমে দু দিন ধরে জ¦রে ভুগছে, প্রবীণ শাশুড়ির গরমে শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। প্রচন্ড তাপে গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা জ্বর, সর্দিতে ভুগছে।
কৃষাণী মর্জিনা বেগম একজন আদর্শ কৃষাণী যিনি দিনের বেশির ভাগ সময় নিজের সবজি ক্ষেতে কাজ করেন। সবজি বিক্রয় করে নিজের দুই ছেলে মেয়েকে পড়া শুনা করাচ্ছেন। কিন্তু গরম বেড়ে যাওয়ায় রাতে শরীরের জ্বর আসছে। শরীর নিয়ে মর্জিনা বেগমের কোন আক্ষেপ নেই! কষ্ট হচ্ছে চলতি মৌসুমে লাগানো কুমড়া, কাকরুল, করলা বরবটি সব গাছের জন্য। সকাল, সন্ধ্যা ও বিকেলে সবজিতে পানি দিয়ে গাছগুলোকে বাঁচাতে পারছেনা! সবজি জমি থেকে মর্জিনার বাড়ির বছরে খাবার চাহিদা পূরণ হয় এবং সবজি বিক্রি করে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় করেন।
বিশ্বনাথপুর গ্রামের কৃষাণী পারভীন বেগমের পুকুরের মাছ সব মরে পানির উপরে ভেসে উঠেছে। প্রচন্ড তাপে পুকুরের পানি দ্রুত শুকিয়ে গেছে। ছোট পুকুরে গরম পানিতে মাছ টিকতে না পেরে মরে পানির উপর ভাসছে। কৃষাণী পারভীন বেগমে বছরের প্রায় ৬ মাস ছোট পুকুরের মাছ থেকে পরিবারে চাহিদা পূরণ করতেন। দরিদ্র কৃষাণী নিজের পুকুরে এ অসহায় রূপ দেখেননি কোনদিন। যে পুকুরের উপর নির্ভর করে পারভীন, তার স্বামী, সন্তান, বৃদ্ধ মায়ের ৬ মাসে মাছের চাহিদা পুরণ করে সেই পুকুরে সকল ছোট বড় মাছ মরে যাওয়ার ফলে আর্থিক, পরিবারের পুষ্টি সংকটের মুখে পড়েছে। এ সমস্যা কিভাবে সমাধান করবে? বা এ সমস্যার সৃষ্টির পেছনে দায় কে নিবে?
কৃষক আব্দুল হাই প্রায় ১০ কাঠা জমিতে বোরো ধান করেছেন। বোরো চাষ করতে গিয়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা ঋণ করেছেন। ধান হওয়ার পর এ ঋণ পরিশোধ করবেন ভেবেছেন। অন্যান্য বছরের তুলানায় এ বছর ধানে ভালো ফলন পাবেন বলে আশা করছিলেন কিন্তু তাপ বেড়ে যাওয়ায় ধান গাছ লাল হয়ে যাচ্ছে। এমন তাপদাহ আরও কয়েকটা দিন থাকলে কৃষক আব্দুল হাইয়ের মতো গ্রামের সকল কৃষকের স্বপ্নের ধান ক্ষেতে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে বলে জানান কৃষক আব্দুই হাই।


জলবাযুর প্রভাবে প্রতিবছর প্রকৃতির নতুন নতুন রূপ ধারণ করছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন সমস্যা। এ সমস্যা সৃষ্টির হওয়ার পেছনের কারণ কখনো খুজঁতে যাননি আব্দুল কাদের মতো কৃষকরা। আব্দুল কাদির প্রতিবছর নিজের বাড়িতে, গ্রামের রাস্তায় গাছ রোপণ করেন বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য। গত বছর বিশ্বনাথপুর ও পাশ^বর্তী গ্রামের যুব সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে প্রায় ২৫০টি তাল গাছ রোপণ করেছেন, চলতি মাসে গ্রামের রাস্তায় রোপনণ করছেন পরিবেশবান্ধব সাজনা গাছ।
পারভীন বেগম বিশ্বনাথপুর গ্রামে নারী সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করছেন। কৃষাণী মর্জিনা বেগম প্রকৃতির এ বিরূপ আচরণের কারণ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। কঠোর পরিশ্রম করে লাগানো ধান, অসময়ে বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়া আবার প্রচন্ড গরমে সবজি গাছ পুড়ে যাওয়ার ঘটনাকে কৃষকরা ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নেন!


কিন্তু আসলে কি শুধু সাধারণ মানুষের ভাগ্যের লিখন নাকি অন্য কোন আর কারণ রয়েছে এর পিছনে? শত বছরে গড় তাপমাত্রা রেকর্ড ভেঙ্গে এ বছর তাপ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন উন্নয়নের নামে বনভূমি নষ্ট করা, নদীর চলার পথ বন্ধ করে দেওয়া, নদ-নদী কমে যাওয়া, হাওরের স্বাভাবিকতা বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ নানান প্রকৃতিবিন্যাসী কর্মকা-ের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব তাপমাত্রা বৃদ্ধি।

প্রচন্ড তাপপ্রবাহ আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখনই প্রয়োজন সকল শ্রেণীর মানুষকে নিয়ে পরিবেশবান্ধব কাজের চর্চা করা।

happy wheels 2

Comments