ক্ষতি যা হবার আমাদের হয়েছে বাপু!
রাজশাহী থেকে ইসমত জেরিন ও ব্রজেন্দ্রনাথ
বরেন্দ্র অঞ্চল আমাদের জনপদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। নানান সংকটে আজ আমাদের প্রিয় বরেন্দ্র ভূমি। এই সংকটের অন্যতম প্রধান বিষয় হলো পানির সংকট। কিন্তু এই পানি সংকটকে দূর করার জন্য মানুষ নির্বিচারে খনন করছে পুকুর কিন্তু তার প্রভাব পড়ছে খাদ্য উৎপাদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। একদিকে মানুষ হচ্ছে জমিহারা অন্যদিকে অপরিকল্পিত পুকুর খননের ফলে বাড়ছে নানাবিধ বিড়ম্বনা। এমনই কথা বলছিলেন রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছী ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত মেম্বার মো. আল আমিন। তার মতে, ”বরেন্দ্র অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে মাছ চাষের জন্য যেভাবে পুকুর খনন করা হচ্ছে তাতে করে লাভবান হচ্ছে গুটিকয়েক মানুষ কিন্তু দূর্ভোগ পোহাচ্ছে শতশত মানুষ। এই অবস্থা চলতে থাকলে এক পর্যায়ে এসে কৃষিজমি আর থাকবে না, দেখা দেবে খাদ্য সংকট।”
সম্প্রতি পবা উপজেলার বড়গাছী ইউনিয়ন পরিষদের পাশাপাশি কানচা পাড়া, মাধবপুর, সুভিপাড়া ও চালগাছি এই ৪টি গ্রামে অন্তর্ভূক্ত বিলে প্রায় ১৫০ বিঘা কৃষি জমিতে ২০টি পুকুর খনন করা হয়েছে কিন্তু অপরিকল্পিত পুকুর খনন করায় মাটিগুলো পাশের পানি নিষ্কাশনের নালায় ফেলা হয় ফলে নালাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। একদিকে যেমন মানুষের বাড়ির ময়লা আবর্জনা আর অন্যদিকে পুকুর খননের মাটির ফেলা কারণেও নালাটি ভরাট হয়ে গেছে। ফলে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে আশেপাশের ধানের জমিসহ পানের বরজ নষ্ট হয়ে অনেক কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন ও বাণিজ্যিক মাছ চাষ প্রসঙ্গে মো. আল আমিন বলেন, “অপরিকল্পিত পুকুর খননের প্রভাবে কৃষিজমি কমে যাওয়ার ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ খাদ্য সংকটের শঙ্কায় পড়ে যাবে”। অন্যদিকে কৃষক মো. আব্দুল রউফ (৫০) বলেন, “আমার ৩ বিঘা বর্গার জমিতে এবার পানি থাকার কারণে আমন ধান চাষ করতে পারিনি, আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে”। তিনি আরও বলেন, বলেন, “প্রশাসনকে বারবার বলার পর পুলিশও এসেছিল কিন্তু কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর আবার পুকুর কাটা শুরু হয়েছে কেউ কিছুই করতে পারেনি, ক্ষতি যা হওয়ার আমাদেরই হয়েছে বাপু। তাতে লোকের কি?”
পুকুর খননের জন্য যে কৃষকরা জমি দিয়েছিল তাদের মধ্যে একজন কৃষক মো. এমাজ উদ্দিন। কেন তারা পুকুর খননের জন্য জমি দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখন তো ধানের দাম নাই আমার এই জমিতে যেখানে ধান বাবদ বছরে ৬ হাজার টাকা পেতাম সেখানে পুকুরের জন্য লীজ দিয়ে বছরে ২৪ হাজার টাকা পাচ্ছি! আমারও তো ছেলে মেয়ে আছে জমি না দিয়ে আর কী বা করব বলো”। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে যারা পুকুরের জন্য জমি দিয়েছিল শুধু তারাই লাভবান হচ্ছে, বাকীরা পড়ছে লোকসানের মধ্যে।
এই চিত্রটি শুধু পবা উপজেলায় নয়; রাজশাহীর গোদাগাড়ী, দূর্গাপুর, বাঘমারাতেও দেখা গেছে। বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিজমিতে লাভজনক হিসেবে মাছচাষের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে যেমন বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্যালারি সিস্টেম ভূমির প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে তেমনিভাবে ভূমির শ্রেণীগত ব্যবহারও পরিবর্তন হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চল হারাচ্ছে তার ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি।
তবে আশার বিষয় হলো বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার কৃষি জমি সুরক্ষা ও ব্যবহার আইন ২০১৫ খসড়া প্রকাশ করেছে যেখানে বলা আছে, “বাংলাদেশে যে সকল কৃষিজমি রয়েছে তা আইনের মাধ্যমে সুরক্ষা করা হবে এবং কোনভাবে তার ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণী বা প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না”।
আমাদের প্রত্যাশা কৃষিজমি সুরক্ষা ও ব্যবহার আইন ২০১৬ এর যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন বরেন্দ্র অঞ্চলকে খাদ্য উৎপাদন হুমকি ও পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে। বরেন্দ্র তার ঐতিহ্য আর বৈচিত্র্য নিয়ে এগিয়ে যাবে।