ব্যয় সাশ্রয়ী কাজের পাশাপাশি উপার্জনমুখী কাজ করছেন মরিয়ম

মানিকগঞ্জ সিংগাইর থেকে রিনা আক্তার
বর্তমান সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাপন অনেক কঠিন হয়ে উঠছে। নিত্য পণ্যের উর্ধ্বগতি বাংলাদেশের নি¤œ আয়ের মানুষের জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। নতুন যুগে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে মানুষ। তাই বাধ্য হয়েই মানুষকে বেছে নিতে হচ্ছে নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র। সমস্যাটি আরো প্রকট হয়ে উঠেছে নারীদের ক্ষেত্রে। বিরূপ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করে কিভাবে জীবন পরিচালনা করছে সেই বিষয়ে আমরা শুনবো বিরুপ সময়ের যোদ্ধা মরিয়ম বেগম এর জীবন সংগ্রামের কথা।


‘‘কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষ্মী নারী”-কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার এই লাইনে বাস্তব উদাহরণ মরিয়ম বেগম। সিংগাইর উপজেলার গোলরা আশ্রায়ন প্রকল্পের ছোট একটি কুটিরে স্বামী, ২ ছেলে এবং ১ মেয়ে নিয়ে সংসার পেতেছেন মরিয়ম বেগম (৩৫)। তাঁর স্বামীর নাম জামাল হোসেন (৪৫), বড় ছেলের বয়স ১৯ বছর। সে একটি গ্যারেজে শ্রমিক হিসেবে আছে, মেজো ছেলের বয়স ১৫ এবং মেয়ের বয়স ১০ বছর। তারা উভয়ই পড়াশুনা করে। তাঁর স্বামী পেশায় রিকশাচালক। তবে শুধুমাত্র রিকশার আয় দিয়ে ৫ জন সদস্যের সংসার চালাতে নৈমিত্তিক হিমশিম খেতে হয় মরিয়মের। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে পুষ্টির চিন্তা করা বিলাসিতা মাত্র। প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটাতে ঋণের আশ্রয় নিতে হয় তাদের। ছোটছেলে-মেয়েগুলোর সামান্য আবদার মেটানোও তাদের কাছে অসাধ্য সাধন করার মতো। পরিবারের জন্য নতুন কাপড় কেনা তাদের কাছে সুদূর স্বপ্নের মতো।


এ পরিস্থিতেই এগিয়ে আসেন মরিয়ম বেগম। প্রজন্ম পরম্পরায় অর্জিত লোকায়ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি পাশে দাঁড়ান তাঁর পরিবারের। শুরু করেন পিঠা তৈরি ও বিক্রির ব্যবস্যা। সিংগাইর সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের একপাশে একটি কাগজের ছাউনির নিচে সকল প্রতিকূলতাকে সাথে নিয়ে মাটির চুলা, পিঠার চড়া, লাকড়ি আর বিভিন্ন রকমারি ভর্তা নিয়ে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নিরলসভাবে পিঠা তৈরি ও বিক্রি করেন মরিয়ম।
মরিয়ম ছোটবেলা থেকেই রান্না করতে বেশ ভালবাসতেন। হরিরামপুর পদ্মার তীরে এক দারিদ্র পরিবারের মেয়ে তিনি। কিন্তু সর্বনাশা পদ¥া তাদের ভিটেমাটিসহ সব কিছু কেড়ে নেয় নিঃস্ব হয়ে একটু আশ্রয়ের খোঁজে চলে আসেন সিংগাইর উপজেলায়। তখন তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। এক সময় তার গোলড়া আবাসনের জামালের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। দুজনে মিলে একটু ভালো থাকার আশায় ঘর বাঁধে আশ্রায়ন প্রকল্পের ছোট ঘরে।


বিয়ের পর যেখানে তাদের দুইজনের খাবারের জোগার করা দুঃসাধ্য সেখানে আরো তিনটি মুখের খাবারের যোগান কিভাবে দিবেন ভেবেই কূল পান না তিনি। এমন সময় তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে শেখা পিঠা বানিয়ে বিক্রির কথা ভাবেন। তখন কিছু টাকা ঋণ করে আতপ চাল, লাকড়ি এবং বিভিন্ন ভর্তার সরঞ্জামাদি কিনেন। সারারাত পানিতে চালগুলো ভিজিয়ে রেখে ভোর রাতে ঢেঁকির সাহায্যে চাল কুটা হয়। তারপর পরিবারের সকল কাজকর্ম শেষ করে পরিবারের সবার জন্য খাবার তৈরি ও খাইয়ে আবার ভর্তা বানানোর কাজে লেগে পড়েন। ভর্তা বানানোটাও তাঁর মায়ের কাছ থেকে শিখেছেন। ভর্তা হিসেবে থাকে ধনেপাতা, চ্যাপা শুটকির ভর্তা, সরিষা, শুকনো মরিচ-রসুনের ভর্তা, খারকন পাতার ভর্তা। সারাবছর চিতই পিঠা বিক্রি করলেও শীতের সময় চালের গুঁড়া, নারকেল আর খেজুরের গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা তৈরি করে বিক্রি করেন তিনি।


মরিয়ম সারা দিনরাত একাধারে পরিবার আর তার ব্যবসা সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এই পিঠা বিক্রি থেকে দৈনিক প্রায় ১৩ থেকে-১৪শ’ টাকা আয় হয় বলে তিনি জানান। একদিকে যেমন পরিবারে ব্যয় সাশ্রয়ী কাজ করছেন অন্যদিকে উপার্জনমুখী কাজ করে চলেছেন। প্রথমে যখন তিনি এই কাজের কথা বলেন তখন সবাই বারণ করেছেন যে এই কাজে কিছু হবে না অযথা সময় নষ্ট হবে। এমনকি পরিবারের কেউও তখন তাঁর পাশে ছিল না। কিন্তু বর্তমানে তার ব্যবসার উন্নতি দেখে পরিবারের সবাই তাঁর কাজে পাশে দাঁড়িয়েছে। তার দেখাদেখি আশ্রায়নের আরো নারীরা এই কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন। মরিয়ম বলেন, ‘‘নারীরা চাইলে এবং আর একটু সুযোগ-সুবিধা পেলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন, পরিবারের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।’

happy wheels 2

Comments