কামার সমাজ উন্নয়নে অঞ্জনা রানী কর্মকার’র উদ্যোগ

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সমাজের অনেক নারী ঘরের বাইরে এসে সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করে সমাজ পরিবর্তনে অবদান রেখে সর্ব পরিচিতি লাভ করেছেন। তাদের এহেন উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সমাজের নারীরা শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করে সক্ষমতা লাভ করছে। নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের কামার পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর সমাজ পরিবর্তনে অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে চলেছেন একই সম্প্রদায়ের শিক্ষিতা নারী অঞ্জনা রানী কর্মকার (৩০)। এলাকায় তিনি ‘অজনাদি’ নামে পরিচিত। ১৯৯০ সালের ১৫ই অক্টোবর নেত্রকোণা জেলার ফচিকা গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। ছোটবেলায় থেকেই তিনি খুব সাহসী। কলেজের শিক্ষার্থী থাকাকালীন অবস্থায় বিয়ে চুড়ান্ত হয় অঞ্জনার। বিয়ে ঠিক হলেও তিনি লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। উচ্চ শিক্ষা নিয়ে মানুষের মত মানুষ হয়ে সমাজ উন্নয়নে কাজ করার সংকল্প করেন। এম.এ.পাশ করার পর পূর্ব থেকে পিতামাতার ঠিক করা তেলিগাতি গ্রামের রঞ্জন কর্মকার’র সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি ২০১৭ সালে নেত্রকোনা শহরস্থ ‘জুয়েল দি হলি চাইল্ড’ স্কুলে প্রধান শিক্ষকের চাকরী নেয়। অদ্যাবধি তিনি এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

20190408_125139-W600

ছোটবেলা থেকেই সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কাজ করা ছিল তার শখ। তাই বিয়ের পর যখন সুযোগ এলো মানুষের জন্য কিছু করার তখন আর সেই সুযোগটা হাত ছাড়া করেননি। তিনি নিজ গ্রাম ও নেত্রকোনা পৌর এলাকার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যোগদান করে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, তালাক প্রাপ্ত নারীদের দেন মোহর আদায়, ভরণ পোষণের ব্যবস্থা, ন্যায় বিচার, দরিদ্রদের আইনী সহযোগিতা পাইয়ে দেয়ার মত সেবা দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকেন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নারী, শিশু, কৃষক ও দলিত জনগোষ্ঠীসহ সকল নির্যাতিত মানুষের উন্নয়নে কাজ করে সফল হয় অঞ্জনা রানী। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সমাজের জনগোষ্ঠীর সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ইস্যুতে নিয়মিত সচেতনতামূলক আলোচনার আয়োজন করে থাকেন। গ্রামীণ সাধারণ জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সব সময় পাশে দাঁড়ান উদ্যোগী ও উদ্যোমী এই সাহসী নারী অজনা রানী। নিজ সমাজের নারী ও শিশুদের উন্নয়নে তিনি নিজ গ্রামের ২০ জন কর্মকার (কামার) নারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘লোহা লষ্কর কর্মকার নারী সংগঠন’ নামে একটি সংগঠন। কর্মকার সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করা, কর্মকার জনগোষ্ঠীর পেশা টিকিয়ে রাখায় উদ্বুদ্ধকরণ এবং সদস্যদের পারিবারিক সমস্যা ও সামাজিক সমস্যাগুলো এ সংগঠনের মাধ্যমে সমাধান করা হয়।

অঞ্জনা রানী বলেন, ‘আমার সামনে নিজ সমাজ ও এলাকার কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিলে খুব খারাপ লাগে। আমি শোনামাত্র বাল্য বিয়ে বন্ধ করতে উদ্যোগ নিই। মেয়ের মা-বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। বোঝাতে ব্যর্থ হলে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সহযোগিতা নিই। এভাবে আমি আজ পর্যন্ত ৫টি বাল্য বিয়ে বন্ধ করেছি। আমার সম্প্রদায়ের (কামার) একজন খুব গরিব পিতা তার ১৫ বছরের এক মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন ৪৫ বছরের এক লোকের সাথে। বিষয়টি শোনামাত্রই আমি ছুটে যাই ওই পরিবারে, মেয়ের বাবা-মাকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আমার কথা মেয়েটির বাবা-মায়ের ভালো লাগে না। তারা তাদের মেয়ের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তে অনড়। আমি কোন উপায় না পেয়ে আমার সম্প্রদায়ের সকল গণমান্য ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করে বিয়েটি বন্ধ করার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করি। অবশেষে সমাজের সকলের চাপে পড়ে ওই মা-বাবা মেয়ের বিয়ে বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এ ঘটনাটি যখন ঘটে আমি তখন কলেজে পড়ি। বিয়ে বন্ধ হওয়ায় কিশোরীটি আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘দিদি আমার জীবনটা বাচাঁলে।’ বাল্যবিবাহ থেকে মুক্তি পাওয়া সে কিশোরী (সন্ধ্যা রানী কর্মকার) আজ অনার্সসহ মাষ্টার্স পাশ করে মনাং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে (সরকারী চাকুরে)। মেয়েটি উচ্চ শিক্ষা নিয়ে এখন স্বাবলম্বী।’

20190408_125153-W600

তিনি আরও বলেন, ‘যখন দেখি গ্রামের কোন বধুকে মারধর ও অপমান করে তখই আমি ছুটে যাই তাদের পাশে, প্রতিরোধ করি নারী নির্যাতন ও অপমানের। আমার ৩০ বছর বয়সে আমি অনেক মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছি। বারসিক’র সহয়তা বিভিন্ন স্কুলে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে অভিভাবক সভা, পরিবেশ দিবস, প্রাণবৈচিত্র্য দিবসসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণার আয়োজন করি। এতে আমি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান না হলেও আমি কিন্তু যথেষ্ট সন্মান পাই। আমার সহযোগিতায় একজন নারী যখন তার স্বামীর ঘরে ফিরে যায় বা ভরণপোষণ পেয়ে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারে তখন মনে এক ধরণের সুখ আসে। তারও তো বেঁচে থাকবার অধিকার আছে, আছে নিজের পছন্দ মত জীবন কাটানোর ইচ্ছা। কোন কন্যা শিশুর বিয়ে বন্ধ করলে, মেয়েটি যখন আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরে তখন আমার অন্তর আত্মা পরিতৃপ্তি পায়। অন্তর থেকে তার জন্য প্রার্থনা করি সে যেন অন্য দশটা মেয়ের মতোই শিশুকালটি কাটাতে পারে, পড়ালেখা শিখে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।’ অঞ্জনা রানী বলেন, ‘নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হতে পারে। নারীদের পদে পদে বাধা, বিয়ের আগে বাবার বাড়িতে, বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে। আর যদি কেউ চাকরি করে তবে সেখানে সহকর্মীদের কাছ থেকেও নানা ধরণের বাধা আসে। অথচ নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছাড়া কোন উন্নয়ন সম্ভব নয়। সকল কাজে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেই আমাদের দেশ সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।’

অঞ্জনা রানী কর্মকারকে এ যুগের বেগম রোকেয়া ও বেগম সুফিয়ার সাথে তুলনা করা না গেলেও তিনি তাদের চেয়ে কোন অংশে কম নন। অঞ্জনা রানী সমাজে পিছিয়ে পড়া কামার সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্ত পরিবারে থেকেও নিজ সমাজ ও এলাকার নারী ও শিশুদের শিক্ষা এবং সামাজিক উন্নয়নে তার অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তার উদ্যোগগুলো এলাকার সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের নিকট প্রসংশনীয় এবং অনুকরণীয়। অঞ্জনা রানীর মত সাহসী ও উদ্যোগী নারী প্রতিটি সমাজে একটি করে থাকলে সমাজের সকল অন্যায়, নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীভূত হবে। সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে একটি বহুত্ববাদী সমাজে, যেখানে থাকবেনা শ্রেণী, পেশা, বয়স ও বর্ণ বৈষম্য। প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপর নির্ভরশীল থাকবে, পরস্পরের মধ্যে আন্তঃনির্ভরশীলতা বিরাজ করবে।

happy wheels 2

Comments