শুভ্রতায় মোড়ানো উৎসবের ঋতু শরৎ
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥
আজি কি তোমার মধুর মুরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে/ হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ ঝলিছে অমল শোভাতে/ পারে না বহিতে নদী জলধার/ মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর/ ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল/ তোমার কানন সভাতে/ মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী/ শরৎকালের প্রভাতে…
এভাবের মনের রঙে কবিগুরু রবি ঠাকুর ছবি এঁকেছেন প্রকৃতির কোনো এক উৎসব মুখর শরতের। বর্ষার বিষণœতা পরিহার করে প্রকৃতির নরম গায়ে আকাশে উঁকি দেয় স্বচ্ছ রোদের দিবালোকে। শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে আবির্ভূত হয় শান্ত স্নিগ্ধ কোমল রূপ নিয়ে, সাদা মেঘখন্ড ভেসে বেড়ায় নিবিড় ছন্দে। নদীর কূলঘেঁষে চরে চরে কাঁশের ফুল দোলে বাতাসের অনিন্দ্য এক দোলনায়। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই, কাঁশফুল আর কাঁশফুল। শরতের সে রূপভান্ডার থেকে যেন রঙ ছিটকে পড়ে প্রকৃতির গায়ে।
পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা আর ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে সারি সারি সাদা কাঁশবন ও কাঁশফুল। মৃদু বাতাস দোলা দিচ্ছে তাদের নরম পাপড়িতে। এই তো চিরচেনা শরৎ। ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে নামে শিউলি ফুল কুড়োতে। আর পাল্লা দিয়ে চলে মালা গাঁথার প্রতিযোগিতা।
শরতের অনুপম রূপবৈভবের মাঝে বেজে ওঠে বাঙালির প্রাণের বাঁশি। আকাশে বাতাসে অনুরণিত হয় উদার মুক্তির আহ্বান। ঘরের বন্ধন ছিন্ন করে অফুরন্ত সৌন্দর্য জোয়ারে ভেসে যেতে চায় মন। শরতের স্পর্শে রূপে-রসে বৈচিত্রে ভরপুর হয়ে ওঠে প্রকৃতি। শরৎ যেন জননী জন্মভূমির রূপসী মানসকন্যা। বাংলার প্রাণের প্রতিম।
সকাল-দুপুর আর অলৌকিক সন্ধ্যার পর ভরা-পূর্ণিমায় ঢাকের শব্দ ভেসে আসে দূর গ্রাম থেকে। নির্জন মাঠে নিঃশব্দে বেড়ে ওঠে নিকট ভবিষ্যতের আমন। তখন শাপলা-শালুকরা পৃথিবীর মোহমায়ায় দু-একটি পাপড়ির ভাঁজ খোলে। যেন শেফালির কোমল পাপড়ির অপেক্ষায় সে অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করে। এভাবেই শারদীয় দিন-রাত আসে, আসে শুভ্রতার প্রতীক হয়ে।
শরতের দিনগুলোকে স্বপ্নের মতোই মনে হয়। চারপাশে ছড়িয়ে থাকে অনেক স্বপ্ন। শরতের আকাশ, শরতের নদী, শরতের ফুল সবকিছুই কেমন যেন শান্ত মায়াময়। শরতের এই স্নিগ্ধ শোভাকে আরো মোহময় করে এ মৌসুমের বিচিত্র ফুলেরা। শরতের ঐতিহ্য হলোÑসাদা শিউলি ফুল, ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দু, পদ্ম ও কাশফুল, রূপ ঝলমল চাঁদের আলো, স্বচ্ছ নীল আকাশ ও তার বুকে ভেসে চলা বৃষ্টি ছাড়া সুন্দর সাদা মেঘ।
শরতের নান্দনিক সৌন্দর্যের সূর্যোদয়, নরম রোদের সকাল, সূর্যাস্তের রং মাখানো অকল্পনীয় অপরূপ রূপের ঘনঘটা, জোছনালোকিত রাতের স্বচ্ছ নীল আকাশ ও তার বুকের জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের সমারোহ দেখে এবং প্রকৃতির সাজ সাজ রব দেখে সবাই মুগ্ধ হতে পারে।
বর্ষার ফুল দোলনচাঁপা শরতেও ছড়ায় তার সুবাস। শরতের সন্ধ্যায় দোলনচাঁপার সাদা পাপড়ি যেন আওড়ায় প্রিয় কোনো প্রেম কাব্য। এ ছাড়াও জবা ফুল, পদ্মফুল, দইগোটার ফুল ফোটে। পদ্মফুলের লাল ও সাদার আভা দেখতে কতই না সুন্দর। পাপড়ির ছড়া বহু গুচ্ছময়। হিন্দু ধর্মলম্বীদের শারদীয় দুর্গা পূজায় পদ্ম ফুল লাগে। পদ্ম ফুলে নীল আভা দেখা যায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে শিউলির বিশাল বন ও তার তীব্র ঘ্রাণের কথা বলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ— সবাই বারবার শিউলির প্রশংসা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ অন্তত আটটি গান ও ২১টি কবিতায় শিউলির প্রসঙ্গ এনেছেন নানাভাবে। শিউলির ভেতরেই যেন তিনি শরতের সব সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছেন।
‘যখন শরৎ কাঁপে শিউলি ফুলের হরষে।/‘প্রশান্ত শিউলি ফোটা প্রভাত শিশিরে ছলোছলো।’
‘আশ্বিনের উৎসবসাজে শরৎ সুন্দর শুভ্র করে/ শেফালির সাজি নিয়ে দেখা দিবে তোমার অংগনে।’
শরৎ উৎসবের ঋতু। শারদ-পূজার প্রধান উপকরণ পদ্ম ফোটে শরতে। নজরকাড়া সৌন্দর্যের জন্য এরাও বিখ্যাত। এ যেন শরতের এক স্নিগ্ধ স্বপ্নের জগৎ।