ধান ও আমাদের জীবন

::বারসিক ফিচার ডেস্ক::

 

প্রায় ১০,০০০ বছর আগে, কৃষকেরাই ভিন্ন জলবায়ু ও সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে বৈচিত্র্যময় অগণিত শস্য ফসলের জাতকে আবাদী জাতে পরিণত করেছে। কৃষিসভ্যতার এ ইতিহাসে যব, জোয়ার কি গমের পর মানুষ খুঁজে পেয়েছে ধান। হিমালয় অববাহিকা ধানের আদি জন্মভূমি। বিশাল বাংলা অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছে এ ধান নানা বর্ণে, নানা নামে, নানা স্বাদে, নানা গন্ধে। এ ধানই কালে কালে হয়ে ওঠেছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য। কেবল খাদ্যদানা নয়, গ্রামীণ অর্থনীতির লাঙ্গল সচল রাখা থেকে শুরু করে পারিবারিক স্বচ্ছলতা, গোষ্ঠীগত ঐক্য, লোকায়ত পার্বণ ও সংস্কৃতি সবকিছুই তাই আদল পেয়েছে ধানকে ঘিরে। ধান যেন তাই বাংলা অঞ্চলে জীবনেরই আরেক রূপ, আরেক নাম। গ্রামবাংলায় ধানই হয়ে ওঠেছে ‘ধনের’ এক জীবন্ত প্রতীক। মূদ্রানির্ভর সভ্যতার এই কালে, এইতো কিছুদিন আগেও গ্রামবাংলার মানুষ ধানের বিনিময়ে কিনেছে কাপড়, তৈজস, তেল কি সংসারের নিত্যদিনের খুঁটিনাটি। ধানকে ঘিরে রচিত হয়েছে খনার বচন, পই, প্রবাদ, ডাক, ডিঠান, শোলক, ধাঁধা, পাঁচালি কি গীতবাদ্য। উজান থেকে পলি নিয়ে নেমে আসা অজস্র জলধারা বাংলাদেশকে গড়েছে এক উর্বর জমিন। হাওর, বিল, কাদা জমি, বালু জমি, চর, নদীর কিনার, গড়, বরেন্দ্র, রাঢ়, উপকূল, পাহাড়, টিলা, বনভূমি কি লবণ মাটি নানান মাটিতে শরীর মেলেছে নানান জাতের ধান। সহ্য করেছে চারপাশের জল-মাটি ও হাওয়ার পরিবর্তন।

[su_slider source=”media: 315,316,317,318,319,320,321,322,323,324″ link=”image”]

বলা হয়ে থাকে বাংলা অঞ্চল জন্ম দিয়েছে প্রায় বিশ হাজার ধান জাত। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট দেশী ধানের জাত নামে একটা পুস্তক প্রকাশ করে। উক্ত পুস্তকে  বাংলাদেশের ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাংগাইল, ফরিদপুর, রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, পাবনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালি, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, বরিশাল, যশোর এই ২০টি জেলার ৩৫৯টি থানার বিভিন্ন অঞ্চল হতে ১২৪৮৭টি স্থানীয় জাতের ধানের নাম নথিভূক্ত করা হয়েছে। কৃষি ও জুম হলো বাংলাদেশের ভূগোল ও অস্তিত্বের সীমানা। কৃষি ও জুমের প্রাণভোমরা ধানসহ নানান জাতের শস্যফসলের বীজসম্পদ। কৃষক ও জুমিয়াদের পাশাপাশি রাষ্ট্রও এই বীজসম্পদ সুরক্ষার কারিগর। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট (ব্রি) হলো দেশের ধান জাত সুরক্ষার রাষ্ট্রীয় প্রহরী। কিন্তু নিদারুণভাবে বারবার এই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় ধানবৈচিত্র্যকে অবহেলা করেছে। ১৯৯৪ সালে ব্রির জিন ব্যাংকে সংরক্ষিত দশ হাজার ধান জাতের প্রায় অর্ধেকই নষ্ট হয় পদ্ধতিগত সংরক্ষণের অভাবে, যার পুনরাবৃত্তি ঘটে আবারো ২০১২ সনে। কৃষকদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় এসব ধানবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষের মধ্য দিয়েই এদেশের কৃষকরা গড়ে তুলেছে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোসহ কৃষি কেন্দ্রিক এক স্বনির্ভর জীবনব্যবস্থা। তাইতো ধান চাষে বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে বীজ বপন, চারা রোপণ, ফসল পরিচর্যা, ফসল মাড়াই, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রান্না, পরিবেশন, আদানপ্রদান কি বিনিময় প্রতিটি পর্বেই গ্রাম-বাংলার নারী-পুরুষেরা পালন করেন ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেশবান্ধবচর্চা।

কিন্তু রাষ্ট্রীয় কৃষিউন্নয়ন কর্মসূচি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক কৃষি উন্নয়ন দেনদরবারে গ্রাম জনপদের শস্য কারগিরদের কোনো স্বীকৃতি নেই। ষাটের দশকে তাই জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয় তথাকথিত সবুজ বিপ্লব। দিনে দিনে গ্রামবাংলার জমিন মাটির তলার পানি হারিয়ে, সংহারী বীজের দাপটে কৃষকের ঘর বীজ শুন্য হয়ে, বিষাক্ত রাসায়নিক বিষে চারদিক হয়ে ওঠে বিষময়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মৃত্তিকা সম্পদ মূল্যয়ন শীর্ষক প্রকল্পের অধিনে মাটির গঠন ও ধরন, বন্যা, জোয়ারভাটা, শস্য বিন্যাস, ফসল চাষের মৌসুৃম, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ এলাকা, ৮৮টি উপ-আঞ্চলিক কৃষি প্রতিবেশ এলাকা এবং ৫৩৫টি কৃষি প্রতিবেশ ইউনিটে ভাগ করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষিপ্রতিবেশের এ ভিন্ন ভিন্ন ধরণকে গুরুত্ব না দিলেও গ্রামবাংলার কৃষক-কৃষাণী চারপাশের ধরণকে আগলে নিয়ে এখনও পর্যন্ত রক্ষা করে চলেছেন জাতের বৈচিত্র্য ও কৃষির ভিত্তিভূমি। পরিবেশ ও জলবায়ুগত নানান পরিবর্তনের ভেতর গ্রামীণ এইসব লোকায়ত ধানচর্চাই বারবার প্রমাণ করে দিচ্ছে টিকে থাকার বৈজ্ঞানিক সত্যকে। চলতি ফটোফিচারের ভেতর দিয়ে ধানকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনের এই লোকায়ত বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির কিছু টুকরো টুকরো মুহূর্তই একত্র করার চেষ্টা করা হয়েছে। গ্রাম বাংলার ধানের এই জয়যাত্রা আরো মজবুত হোক। আপনিও এই লড়াইয়ে অংশ নিন। ধান ও আমাদের জীবন এখনো এক অভিন্ন ধারায় বহমান।

happy wheels 2